ডেঙ্গু আরও শক্তিশালী হয়েছে

এ বছর গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টির দাপট শুরুর আগে চিকুনগুনিয়া, না ডেঙ্গু—কার যন্ত্রণার পাল্লায় পড়বে দেশ, তা নিয়ে গত ৩১ মার্চ  প্রথম আলোতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এবার চিকুনগুনিয়া আড়ালেই থেকেছে আর প্রচণ্ড প্রতিপত্তি নিয়ে গজরাচ্ছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু শুধু যে তার প্রভাববলয় বাড়িয়েছে তা নয়, বরং তার রং আর চেহারাতেও বিস্তর পরিবর্তন এনেছে। ফলে ডেঙ্গুর মতো অবহেলিত রোগ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায় নেগলেগটেড ডিজিজ) মারাত্মক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলার চেনা পন্থাগুলো এখন আর কার্যকর থাকছে না। ঢাকার এক প্রান্তের মেয়র কয়েক সপ্তাহ আগে বলেছিলেন, এবার রোগীর সংখ্যা বেশি, তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু রাজধানীর অভিজাত, কম অভিজাত কি অনভিজাত এলাকা প্রায় সর্বত্র এখন ডেঙ্গুর রাজত্ব। এর মধ্যে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা, হাতিরপুল, আজিমপুর কলোনি, পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, বাসাবো, খিলগাঁও, মানিকনগর ও যাত্রাবাড়ীতে এর প্রকোপ বেশি। মেয়র আরও বলেছিলেন, গত বছর চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল, এবার নেই। ঘটনা সত্য। চিকুনগুনিয়ার ধর্ম এটা, জলবসন্ত বা চিকেন পক্সের মতো সে দ্বিতীয়বার একই ব্যক্তির কাছে ফিরে আসে না। এর পেছনে আমাদের কোনো কেরামতি নেই। কিন্তু ডেঙ্গু ফিরে ফিরে আসে, দ্বিতীয়বার সে আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে আসে। যে চারটি চিহ্নিত ভাইরাস (ডেন-১ ডেন-২ ডেন-৩ ডেন-৪) থেকে ডেঙ্গু হচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, তার একটাতে কোনো ব্যক্তি একবার আক্রান্ত হলে তার শরীরে ওই বিশেষ ডেঙ্গুর প্রতিরোধ শক্তি গড়ে ওঠে। কিন্তু সে অন্য প্রকৃতির ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আন্তপ্রতিরোধ বা ক্রস ইমিউনিটি (অর্থাৎ এক প্রকৃতির ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সব ধরনের ডেঙ্গু থেকে নিস্তার পাওয়া) প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। দু–একটি ক্ষেত্রে ঘটলেও তা নেহাত স্বল্পমেয়াদি। বরং দ্বিতীয়বার আক্রান্তদের আরও ভয়ানক পরিণতির মখোমুখি হতে হয়।

নতুন ডেঙ্গু

বাংলাদেশও এবার এই চক্রের মধ্যে পড়েছে। ডেন–৩ ডেঙ্গুর বিস্তার দেখা যাচ্ছে, যা আগের বছরগুলোয় দেখা যায়নি। এই জাতের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তি চেতনা হারাতে পারে। তা ছাড়া হার্ট, কিডনিসহ শরীরের অভ্যন্তরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো (মাল্টিপল অরগান ফেইলিউর) হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা  বলছেন, গত ১৬ বছরের মধ্যে এবারই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছে মোট ৬ হাজার ৪৭৯ জন, মারা গেছে ১৬ জন। এ থেকে বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক। এই হিসাব শুধু নগরের সরকারি হাসপাতালের। বাংলাদেশে উদ্বেগের আরও একটা নতুন মাত্রা আছে। এ দেশে শিশুরা বেশি মারা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারি সূত্রগুলো যে ১৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, তাদের মধ্যে ৮ জনেরই বয়স ১২ বছরের নিচে। এবার ভারত, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইয়েমেনসহ যেসব দেশে ডেঙ্গু ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং মৃত্যুর সঠিক হিসাব রাখছে, সেখানে কিন্তু শিশুমৃত্যুর হার এত বেশি নয়। শিশুর প্রতি আমাদের ধারাবাহিক অবহেলা কি এর কারণ? না প্যারাসিটামল দিয়ে দিয়ে তার জ্বর দাবিয়ে রাখায় এই সংকট? কিন্তু কারণটা জানা খুবই জরুরি।

রোগী বাড়ছেই

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। এদের প্রায় সবাই অচেতন অবস্থায় বা শকে চলে যাওয়া রোগী। তাদের রক্তের চাপও মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় রক্তের প্লাজমা ক্ষরণ (প্লাজমা লিকিং) শুরু হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার চার-পাঁচ দিন পর থেকেই রোগীর শরীরে প্লাটিলেট কমতে থাকে। একটা পর্যায়ের পরে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে প্লাজমা ক্ষরণ হতে শুরু হয়। প্লাটিলেটের মাত্রা প্রতি মিলিগ্রাম রক্তে ২০,০০০-এ এসে ঠেকলে রোগীকে বাইরে থেকে প্লাটিলেট দিতে হয়। না হলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যার বিষয় হলো প্লাটিলেট পাঁচ দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে কোনো রোগীর প্লাটিলেটের প্রয়োজন হলে দাতারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে যা কষ্টকর ব্যাপার। ঢাকার বাইরে কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া এই সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। কাজেই দেশব্যাপী একটা দাতা তথ্যব্যাংক গড়ে তোলা প্রয়োজন। ভারতে ইতিমধ্যেই ডেঙ্গু রোগীরা যাতে খুব সহজে প্লাটিলেট পেতে পারেন, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আক্রান্তদের সাহায্য করতে তৈরি করা হয়েছে একটি অনলাইন কমিউনিটি। সেটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক লাখের বেশি সম্ভাব্য দাতা। চালু করা হয়েছে বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর। এ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে ডেঙ্গু রোগীদের রক্ষায় আমরা অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারি।

প্রতিরোধ আমাদের হাতে

সম্ভাব্য আক্রান্তদের রোগনির্ণয়, রেফারেলের সুযোগসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা ইত্যাদি কাজে সরকারকে নিশ্চয় আরও তৎপর ও উদ্যোগী হতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। মশা যে কত ভয়ানক ও প্রাণঘাতী হতে পারে, তা নগরবাসী এখনো না বুঝলে কবে, কখন বুঝবে? আমরা ভাবছি, টবে পানি জমতে না দিলেই মশার যম থেকে আমরা বেঁচে যাব। কিন্তু এডিস মশার ডিম খটখটে শুকনো জায়গাতেও যে বছর দুয়েক দিব্যি তাজা থাকতে পারে, তা কি আমরা জানি? টবের পানি ফেলে দেওয়ার চেয়ে জরুরি আমাদের কঠিন (সলিড) বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য নাগরিকদের যুক্ত করতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী ও গবেষক