আরেকটি সীমা লঙ্ঘন করল সৌদি আরব

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও সাংবাদিক জামাল খাসোগি।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও সাংবাদিক জামাল খাসোগি।

গভীর বিষাদ নিয়ে এই লেখা লিখছি। তুরস্কের দিক থেকে বলা হচ্ছে, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরেই খুন করা হয়েছে। সৌদি বলছে, খাসোগি কনস্যুলেটে এসেছিলেন। তবে সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে গেছেন। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ নেই। খাসোগি যদি সত্যিই খুন হয়ে থাকেন, তাহলে আমি এই মেধাবী, একনিষ্ঠ ও আদর্শ সাংবাদিক ও লেখকের মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। তাঁকে আমি এমন একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবে জানি, যিনি তাঁর দেশকে ভালোবাসতেন এবং মাতৃভূমির বুকে ঘটে যাওয়া রাষ্ট্রীয় অন্যায়–অবিচারের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করতেন।

১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমি খাসোগিকে চিনি। ২০০২ সালে জেদ্দায় তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি উপসাগরীয় এলাকার নেতৃস্থানীয় পত্রিকা আরব নিউজ-এর উপপ্রধান সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে আলাপের পর আমি তাঁর চরিত্রের দুটি বিষয় দেখে খুবই চমৎকৃত হয়েছি। একটি হলো আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোকে তিনি এমন হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করতেন, যা এককথায় বিস্ময়কর। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো তিনি নিজ দেশ সৌদি আরবের রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোয় পরিবর্তন আনার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ভূমিকায় ছিলেন। তিনি মনে করতেন, সৌদি সরকারের সমালোচকেরা দেশটির জন্য হুমকি নন। তিনি মনে করতেন, একমাত্র গঠনমূলক সমালোচনার মধ্য দিয়েই সৌদি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

সৌদি শাসন ও সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার মানস থেকেই তিনি সে দেশের শাসকগোষ্ঠী ও রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের ভুলত্রুটি মাঝেমধ্যে যত দূর সম্ভব তুলে ধরতেন। এ কারণে সম্পাদকীয় অবস্থান থেকে তিনি বেশ কয়েকবার বরখাস্তও হয়েছিলেন। তিনি ‘গুম হওয়ার’ আগ পর্যন্ত নিজের এই লক্ষ্যকে সঠিক বলে মনে করে গেছেন।

২ অক্টোবর জামাল খাসোগি ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ঢুকেছিলেন এবং তখন থেকেই তাঁর কোনো খোঁজ নেই। সৌদি সরকার দাবি করেছে, খাসোগি নিজের কাজ সেরে কনস্যুলেট ত্যাগ করেছেন। তবে তুরস্ক এই কথা অস্বীকার করেছে। তুরস্কের কর্মকর্তাদের ভাষ্য থেকে সবাই যেটি ধারণা করছে, সেটি হলো খাসোগি কনস্যুলেটের মধ্যে ঢোকার পরপরই তাঁকে মেরে ফেলা হয় এবং কূটনৈতিক প্লেটসংবলিত একটি গাড়িতে করে তাঁর লাশ বাইরে নিয়ে গুম করে ফেলা হয়।

যদি সত্যি তা–ই হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে সৌদি আরব সভ্যতা–ভব্যতা ও আইনকানুনের আরেকটি সীমা লঙ্ঘন করেছে। সৌদি সরকারের অপহরণ করা এবং শাসক পরিবারের সদস্যদের অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁদের জোর করে ধরে আনার রেকর্ড আছে। সৌদির ইতিহাসে রক্ষণশীল বা উদার—যে সরকারই থাকুক না কেন, তাদের প্রায় সবাই সমালোচকদের জেলখানায় ঢুকিয়েছে। কিন্তু ভিন্ন একটি দেশে নিজেদের কনস্যুলেট ভবনকে হত্যার জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়ার ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি। খুব বেশি দিন হয়নি, যখন কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার সাংবাদিকদের ওপর ঘৃণ্য হামলা চালালে যুক্তরাজ্য সরকার তার তীব্র প্রতিবাদ করত এবং এ ধরনের হামলা রোধে দেশটি তার প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত। জামাল খাসোগি নিখোঁজ হওয়ার পরই এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে আমার দেশ যুক্তরাজ্য মুখে কুলুপ এঁটে আছে। শেষ পর্যন্ত যদি এই ঘটনার প্রতিবাদ করেও, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস জামাল খাসোগির পক্ষে কিছু বলবে এমন আশা অবশ্য আমার ছিল না। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন সৌদি আরবে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় অভিযান চলছে, তখন খাসোগি যুক্তরাষ্ট্রে একরকম পালিয়ে চলে আসেন এবং ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় কলাম লিখতে শুরু করেন। পণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান আমাজনের মালিক জেফ বেজোসের মালিকানাধীন পত্রিকাটি ট্রাম্পের কড়া সমালোচকের ভূমিকায় থেকেছে এবং পত্রিকাটির অনেক খবরকে ট্রাম্প ‘ফেক নিউজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সেদিক থেকে ট্রাম্পের খাসোগির প্রতি আগ্রহ থাকার কথা নয়।

ট্রাম্প তাঁর সমালোচক সাংবাদিকদের ‘জনগণের শত্রু’ আখ্যায়িত করেছিলেন। সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (যিনি ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদিতে একটি উদার সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) কিন্তু জামাল খাসোগিকে জনগণের শত্রু হিসেবে মনে করেননি। তিনি তাঁকে ব্যক্তিগত শত্রু হিসেবেই ধরে নিয়েছেন। খাসোগি আসলে ভেতরে-ভেতরে এই কর্তৃত্ববাদী সরকারের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছিলেন। সৌদি সরকার এ কারণে মনে করেছে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। তবে সৌদি আরবের রাশ এখনই টেনে ধরা দরকার। জামাল খাসোগিকে স্মরণে রাখা দরকার।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

বিল ল: আল–জাজিরার নিয়মিত কলাম লেখক