প্রার্থীদের যা জানা জরুরি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ধারণা করা হচ্ছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচনী কর্মকাণ্ড আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হওয়ার নিশ্চয়তা থাকলেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান—এমন অনেক ব্যক্তিই নির্বাচনী বিধিবিধান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না। সম্ভাব্য প্রার্থীদের অবগতির জন্য নির্বাচনসংক্রান্ত কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান নিচে তুলে ধরা হলো।   

সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে সম্ভাব্য প্রার্থীকে বাংলাদেশের যেকোনো নির্বাচনী এলাকার ভোটার হতে হবে, কিন্তু যে এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেই এলাকার ভোটার হওয়া তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তবে মনোনয়নপত্রে প্রস্তাবকারী ও সমর্থনকারীকে অবশ্যই ওই নির্বাচনী এলাকার ভোটার হতে হবে। প্রতিটি মনোনয়নপত্র প্রার্থী বা তাঁর প্রস্তাবকারী বা সমর্থনকারী রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে দাখিল করবেন, যিনি তারিখ ও সময় উল্লেখ করে প্রাপ্তিস্বীকার করবেন। এখন পর্যন্ত অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-তে নেই, যদিও নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছে বলে শুনেছি।

প্রার্থীকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে একটি হলফনামা, নির্বাচনে সম্ভাব্য ব্যয়ের উৎস ও সর্বশেষ বছরের আয়কর বিবরণীর কপি জমা দিতে হবে। অতীতে অনেকে শুধু আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার এনবিআর কর্তৃক প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করেছেন, যা আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আরও জমা দিতে হবে জামানত হিসেবে ২০ হাজার টাকা। তবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় কোনো মিছিল ও মহড়া করা যাবে না।

অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিসম্পন্ন মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময়ে বাতিল হতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধনযোগ্য ভুলের জন্য সাধারণত মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয় না। তবে হলফনামায় উল্লেখ করা কোনো তথ্য মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় পরিবর্তন বা সংশোধন করা যাবে না।

আমাদের দেশে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার কিছু বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত আছে। তবে গত পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে, বিশেষ করে ফেনীতে এটি নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালের পৌরসভা নির্বাচনে ফেনী, দাগনভূঞা ও পরশুরাম উপজেলায় মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধার কারণে মোট ৫১টি পদের বিপরীতে দুই মেয়রসহ ৪৭ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তাই আগামী নির্বাচনে বিশেষ প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা প্রদানের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

হলফনামায় আট ধরনের তথ্য জমা দিতে হয়: প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, বর্তমান ও অতীতের ফৌজদারি মামলার বিবরণ, পেশা, আয়ের উৎস, নিজের এবং নির্ভরশীলদের সম্পদ ও দায়দেনার বিবরণ এবং অতীতে সংসদ সদস্য হলে ভোটারদের কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নের বিবরণ। হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে কিংবা তথ্য গোপন করলে মনোনয়নপত্র বাতিল, এমনকি পরবর্তী সময়ে নির্বাচনও বাতিল হতে পারে। তাই হলফনামা প্রস্তুতের ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে, কারণ ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশন হলফনামা যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ ব্যাপারে বিশেষ করে যত্নবান হওয়ার আরও কারণ হলো যে হলফ করে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৮১ ধারার অধীনে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি একজন প্রার্থীর হলফনামা চ্যালেঞ্জ করে ‘বিরুদ্ধ হলফনামা’ দাখিল করতে পারবেন।

ঋণ ও বিলখেলাপিরা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য। আরও অযোগ্য বিদেশি সাহায্যপুষ্ট বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী, যাঁর পদত্যাগ বা অবসরের পর তিন বছর অতিবাহিত হয়নি। একই ধরনের বিধান সরকারি কর্মকর্তা এবং সামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ ছাড়া অযোগ্য নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি, যাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়নি।

তবে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি কখন থেকে—বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রথম দণ্ডপ্রাপ্তির দিন থেকে না আপিল প্রক্রিয়া নিঃশেষিত হওয়ার পর—তা আমাদের উচ্চ আদালত এখনো সুরাহা করেননি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনাম আবদুল মুক্তাদির চৌধুরী [২৬ বিএলডি ২৬১ (২০০২)] মামলার রায়ে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী হিসেবে এরশাদের কখন থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অযোগ্যতা শুরু হবে, সে ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন রায় দেন যে আপিল–প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। পক্ষান্তরে বিচারপতি খায়রুল হকের মতে, দণ্ড ঘোষণার দিন থেকেই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য হবেন। পরবর্তীকালে আপিল বিভাগ এ বিষয়টি সুরাহা করেননি। এমনকি ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বনাম নির্বাচন কমিশন [৬২ ডিএলআর (এডি) ২০১০] মামলায়ও হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনাম আবদুল মুক্তাদির চৌধুরী, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বনাম বাংলাদেশ এবং মো. মামুন বনাম ওয়ালিদ হাসান বনাম রাষ্ট্র (ক্রিমিন্যাল মিসিলেনিয়াস কেস, ১০০০৯/২০০৭) মামলার রায় থেকে এটি সুস্পষ্ট যে উচ্চ আদালত দণ্ডিত অপরাধীর দণ্ড ও কনভিকশন স্থগিত করলে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

একজন ব্যক্তি দুইভাবে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন: স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী হিসেবে। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে, যিনি অতীতে কখনো সংসদ সদস্য ছিলেন না, নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরসংবলিত একটি তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। অতীতে সংসদ সদস্য ছিলেন এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য নয়। ১ শতাংশ ভোটারের তালিকা সম্পর্কে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত কেউ তাঁর স্বাক্ষর জাল বলে দাবি করলে মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে।

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি বা সমপর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তিকে একটি প্রত্যয়নপত্র দাখিল করতে হবে যে তাঁকে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছে। দল একাধিক ব্যক্তিকে এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র দিতে পারে।

নিবন্ধিত দলের মনোনয়ন নির্ধারণের লক্ষ্যে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের ভোটে একটি প্যানেল তৈরি করা বাধ্যতামূলক। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিও সংশোধন করে দলীয় মনোনয়ন বোর্ড কর্তৃক তৃণমূলের তৈরি এ প্যানেল থেকে মনোনয়ন দেওয়ার বিধান করা হয়। তবে অধ্যাদেশটি ২০০৯ সালে সংসদে অনুমোদনের সময় এ বিধানটি শিথিল করে শুধু প্যানেলটি বিবেচনায় নেওয়ার বিধান করা হয়, যার ফলে দলীয় মনোনয়নে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ভূমিকা নিছক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে।

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের বিধানটি সম্ভাব্য প্রার্থীদের, বিশেষত দলীয়ভাবে মনোনীত প্রার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাঁর স্বাক্ষরযুক্ত একটি লিখিত নোটিশ, প্রত্যাহারের দিনে বা তার আগে, রিটার্নিং অফিসারের কাছে নিজে বা প্রতিনিধি মারফত দাখিল করে তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারবেন। দলীয়ভাবে মনোনীত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে কোনো আসনে দলের পক্ষ থেকে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমার মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি বা সমপর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তিকে দলের চূড়ান্তভাবে মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম লিখিতভাবে নিজে বা প্রতিনিধি মারফত রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অবহিত করতে হবে।

দলের পক্ষ থেকে প্রতিটি আসনের জন্য একজনকে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অবহিত করলে, প্রতিটি আসনে দলের প্রাথমিকভাবে মনোনয়নপ্রাপ্ত অন্যদের মনোনয়নপত্র আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যাবে; অর্থাৎ দল থেকে কেউ মনোনয়ন চাইলে, দলের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিলে এবং তিনি দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন না পেলে তাঁর পক্ষে বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই কোনো প্রার্থী যদি মনে করেন যে তিনি দল থেকে মনোনয়ন পাবেন না, কিন্তু তিনি প্রার্থী হতে চান, তাহলে তাঁর জন্য দলের মনোনয়ন চাওয়া হবে আত্মঘাতী।

ড. বদিউল আলম মজুমদার : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক