২১ আগস্ট ঘটনার বহুমাত্রিকতা

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ফাইল ছবি
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ফাইল ছবি

হাজার হাজার বছর ধরে দুনিয়াতে যত নাশকতামূলক কাজ হয়েছে, তার কোনোটিরই পুরো রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। যেসব নাশকতামূলক কাজ রাষ্ট্রের কোনো না কোনো গোত্রের মদদে অথবা সহযোগিতায় ঘটেছে, সে রহস্য অনুদ্ঘাটিত থাকবে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত। কোনো একদিন হয়তো তার আংশিক সত্য উদ্ঘাটিত হয়, পূর্ণ সত্য পৃথিবীর মানুষ জানবে না এবং সেই অসম্পূর্ণ সত্যটুকুও যখন জানা যায়, তখন তা জানা আর না জানা সমান।

ষাট ও সত্তরের দশকে আমেরিকার কয়েকটি সুপার মার্কেটে বোমা বিস্ফোরণে বহু মানুষ হতাহত হয়। সেসব সন্ত্রাসবাদীদের কাজ বলে প্রচারিত হলেও একসময় জানা যায়, সেসব ছিল সিআইএ অথবা আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পিত ও সংঘটিত নাশকতা। সাম্প্রতিক কালের দুনিয়া কাঁপানো নাইন-ইলেভেনের নারকীয়তার রহস্য সরকারিভাবে উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। হবেও না। বেসরকারি অনুসন্ধান থেকে নানা রকম বিশ্লেষণ তথ্য-উপাত্তসহ প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু তাতে সত্যের পরিমাণ কত ভাগ, তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, যে মার্কিন গোয়েন্দারা বিশ্বের কোথায় কার ঘরে কখন ইঁদুর ঢুকছে, তা জানতে পারেন, তাঁরা নিজের ঘরের দিনদুপুরের অত বড় ঘটনার রহস্য উন্মোচনে ব্যর্থ। কখনো কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থ হওয়ার প্রয়োজন হয়। সত্য একটিই—তা যখন ধামাচাপা দেওয়া হয়, তখন মিথ্যা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। সবচেয়ে বেশি বিস্তারিত হয় অনুমানপ্রসূত কল্পকথা। তবে দুনিয়া এমন এক আজব জায়গা, যেখানে কল্পকাহিনির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সত্য।

দীর্ঘ সময় বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড মামলার রায় হয়েছে। ঘটনাটি ছিল জাতির ইতিহাসে এক ভয়ংকর নারকীয়তা। ঘটনাটি ঘটার ঘণ্টা দুই পর আমি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর অকুস্থলের কাছাকাছি গিয়ে দেখেছি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য: রাস্তার মধ্যে রক্ত এবং শত শত স্যান্ডেল। তারপর সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি ও শুনেছি আহত ব্যক্তিদের আর্তনাদ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতাও মারাত্মক জখম হয়েছিলেন।

ঘটনাটি দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে করুণা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। কিন্তু সরকারের একটি গোত্রের মধ্যে বিশেষ ভাবাবেগ পরিলক্ষিত হয়নি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মাথা খারাপ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দেখা গেল তিনি ভাবলেশহীন। তারপর সত্যিই তাঁর মাথা খারাপের লক্ষণ প্রকাশ পেল যখন তিনি পৈশাচিক ঘটনাটি সম্পর্কে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে এমন বয়ান দিলেন, যা শুনে বহু মানুষেরও মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। তিনি তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন না করে অপরাধীদের বাঁচাতে অন্য রকম গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন।

ভাববাদী দার্শনিক ও মরমি আউল-বাউলেরা বলেছেন, এ জগৎ রহস্যময়, মানুষের বোধহীন সত্যের সন্ধান সম্ভব নয়। অবশ্য তাঁরা মহাজাগতিক রহস্যের কথা বলেছেন, বঙ্গীয় রাজনীতির রহস্যের কথা বলেননি। যদি বাংলার রাজনীতির রহস্য নিয়ে ভাবতেন, তাহলে দেখতে পেতেন, মহাজাগতিক রহস্যের চেয়ে বাংলার মাটিতে সংঘটিত বিচিত্র ঘটনার রহস্য আরও অজ্ঞেয়।

২১ আগস্টের ঘটনার পর সরকার একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল। তাঁর রিপোর্ট প্রকাশের পর আমি তা পত্রিকায় পাঠ করে আমার কলামে লিখেছিলাম, এ তো দেখছি নীহাররঞ্জন গুপ্তকে হার মানিয়ে ছাড়বেন। তাঁকে দিয়ে তদন্ত না করিয়ে ফ্রিডম পার্টির কোনো নেতাকে দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করলেও একই রকম রিপোর্ট পাওয়া যেত।

আমার মতো সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকেনি যে বিষয়টি তা হলো, সেই সরকারের পক্ষে সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের নিরপেক্ষ বিচারের আওতায় আনতে অসুবিধা ছিল কোথায়? ওই ঘটনা মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘটানো হয়নি—সরকারের কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারেন। ওই ঘটনা সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভার সিদ্ধান্তমতো ঘটানো হয়নি—দলের কোনো কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন।
সুতরাং সরকারের ভেতরে যারা জড়িত এবং দলের যারা জড়িত, তাদের বিচার হলে সরকারের ও সরকারি দলের খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল না। বিশেষ করে জজ-ব্যারিস্টারদের দিয়ে নাটক সাজিয়ে সরকারের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, সুষ্ঠু বিচার করলে ক্ষতি তার চেয়ে অনেক কম হতো।

মামলা উচ্চ আদালতে যাবে, নিম্ন আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, এই ঘটনার সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোক, সরকারি দলের ক্ষমতাবান ব্যক্তি, ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের নেতা, পুলিশ এবং সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের অনেকে জড়িত। একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে ২১ আগস্ট একটি ক্ল্যাসিক ঘটনা। ১৯৯৮-৯৯ থেকে বিশ্বের কয়েকটি প্রভাবশালী সাময়িকী ও প্রচারমাধ্যম বড় বড় প্রতিবেদন করছিল যে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গির উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। ২০০৫ সালে ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় প্রমাণিত হয় যে সত্যি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। যদিও সেই ঘটনার রহস্যও উদ্ঘাটিত হয়েছে বলে মানুষ মনে করে না। ২১ আগস্টের ঘটনায় প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশ জঙ্গিদের কারণে একটি বিপজ্জনক ভূখণ্ড।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের ওপর, সেই সব বাহিনীর কর্মকর্তারা সরকারের অনৈতিক আদেশ শুনতে বাধ্য নন। ব্যক্তিগত স্বার্থে কেউ কেউ তা চিরকালই করেন। যেসব শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে, তাতে ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের বদনাম হলো, তা-ই নয়, তাঁরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে হেয়প্রতিপন্ন করলেন। এ কথা মনে করার কারণ নেই যে ওই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে শুধু তাঁদের মতোই কয়েকজন নষ্ট কর্মকর্তা ছিলেন, আর কেউ নেই। সব সময়ই তাঁদের মতো অসাধু ও সুবিধাবাদী থাকতে পারেন। বিষয়টি ওই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ভাবা প্রয়োজন। তা না হলে মানুষের মধ্যে ওই সব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থেকে যাবে।

রায়ে বিচারক কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনীতি মানে বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ হতে পারে না। এ রাজনীতি দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা হতে পারে না। এটা হলে মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়বে। আদালত বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যে দলই থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদারনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলের নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়।

এই পর্যবেক্ষণ তখনকার সরকার সম্পর্কে বলা হলেও সব সরকারের জন্যই প্রযোজ্য—বর্তমান ও ভবিষ্যতের সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা ভালো, নিঃশেষ করার অপচেষ্টা গণতন্ত্রের চরম পরিপন্থী।

২১ আগস্টের ঘটনাটি কোনো সাধারণ সন্ত্রাসী ঘটনা নয়, একটি ফৌজদারি অপরাধ নয়, একটি ক্ষমাহীন রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ। ওই ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন কিন্তু সেদিন যদি বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা করা হতো, তার বিরূপ প্রভাব হতো বহুমাত্রিক ও সুদূরপ্রসারী। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ পেতে পারত একটি ভিন্ন মাত্রা। ওই সরকারেরও পতন ঘটতে পারত এবং বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদলে যেত। তবে ওই ঘটনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সরকারের অসত্য বয়ানকে পত্রপত্রিকা প্রশ্রয় দেয়নি।

আদালত একটি ফৌজদারি মামলার রায় দিয়েছেন। ঘটনাটির রাজনৈতিক দিক বিচার আদালতের কাজ নয়। সরকারের উচিত হবে এ সম্পর্কে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। তবে সেই শ্বেতপত্র যদি বস্তুনিষ্ঠ না হয়, তাতে প্রকাশ ঘটে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির, তাহলে তা হবে বিএনপি সরকারের তদন্তের মতোই মূল্যহীন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক