'আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম'

১ অক্টোবর ছিল প্রবীণ দিবস। ওই দিন খবরের কাগজে কিংবা অনুষ্ঠিত সভায় প্রবীণদের প্রতি সমাজ ও পরিবারের কর্তব্য ও দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা হতে দেখলাম। কিন্তু বর্তমানে তাঁদের প্রকৃত অবস্থার বর্ণনা কোথাও চোখে পড়েনি। স্বভাবতই আমার আব্বার জীবনসায়াহ্নে তাঁর বৃদ্ধ বয়সের মর্মন্তুদ কাহিনির দৃশ্য বারবার মনে পড়ে যায়।

আমার আব্বা ১৯৯২ সালের ১২ জুন ৯২ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে আমি আমার ছোট বোন পারুর জরুরি ফোন পেয়ে নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরে আসি আব্বাকে দেখতে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ছেলেমেয়ের লেখাপড়া শেষ না হওয়ায় আমি সপরিবার নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলাম।

ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ভাইবোনদের বাসাবাড়িতে পৌঁছে দেখি, আব্বা আমার লন্ডনপ্রবাসী ছোট ভাই ড. মবিনের দ্বিতীয় তলার বাড়ির নিচতলার বাইরের ঘরে থাকেন। আম্মার স্মৃতিবিজড়িত এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় দীর্ঘদিন তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে থেকে কেন এখানে চলে এলেন, আজও জানতে পারিনি। আমার জানামতে, বড় ভাবি তাঁর যত্নের ত্রুটি করেননি। এখানে আমার আব্বাকে দেখাশোনা করে স্বামী-স্ত্রী দুই পরিচারক-পরিচারিকা নাসির ও জোলেখা।

পারু বলল, প্রথমে আব্বা পারু ও অন্য বোন নূরজাহানের বাসায় ছিলেন। পরে তাঁরই ইচ্ছায় এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুটা অবিশ্বাসের সঙ্গে আমি ভাবি, বুড়ো বয়সে মৃত্যুভয়ে কাতর একাকী মানুষ তো ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির সান্নিধ্যে থাকতে অনেক বেশি স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করে।

মুহূর্তের জন্য আমি ঘরের চারদিকে চোখ বোলাই। দেয়ালের পাশে একটি আলনায় দুটি লুঙ্গি, দুটি গেঞ্জি ও দুটি পাঞ্জাবি এবং একটা গামছা।
ঘরের কোণে দৃশ্যত তাঁর একমাত্র সঙ্গী একটা সাদা-কালো টেলিভিশন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো পরিত্যক্তই হবে। একটা চেয়ার ছাড়া ঘরে আর কোনো আসবাব নেই।

যাঁরা আব্বাকে দেখতে আসেন, বিছানায় বসেই কথা বলেন। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন শ্রীহীন ও মলিন ছিন্ন পরিবেশ। যেন সব সম্মান, প্রতিপত্তি, ধনদৌলত ত্যাগ করে নিঃস্ব ও রিক্ত হস্তে মহাপ্রস্থানের প্রস্তুতি। যেন ঘরের বাইরে আঙিনায় আবর্জনা ফেলে রাখা, যার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। একজন অতিরিক্ত, যাকে সহ্য করেছি কিন্তু স্বীকার করিনি।

নিমেষেই মনটা একটা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তাঁর এ বিপন্ন অস্তিত্ব দেখে। আব্বা জেগে উঠে আমাকে দেখে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘বাবা এলি। আমার সময় শেষ। তোর অপেক্ষায় ছিলাম।’ আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিই। একটু পর আব্বা বললেন, ‘ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দে তো বাবা, বড্ড গরম।’

আমি বললাম, ‘বাড়ানোই তো আছে।’ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আর্তনাদ করে। আমরা আব্বার জন্য একটা এসিও কিনে দিতে পারিনি। এখনো প্রতিবারই যখন আমার শোবার ঘরে এসির সুইচ টিপ দিতে যাই, আব্বার সেই করুণ কণ্ঠস্বর—‘বড্ড গরম, ফ্যানটা একটু বাড়িয়ে দে তো বাবা’—শুনতে পাই। আমি সুইচ না টিপে শুয়ে পড়ি বিছানায়। গরমে ছটফট করে আমার সীমাহীন ব্যর্থতার দায়মুক্তির জন্য প্রায়শ্চিত্ত করি।

আমার জন্য আরও একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বেলা একটা বেজে গেছে। আব্বা বললেন, খিদে পেয়েছে। জোলেখাকে বললেন, ‘কে আজকে খাওয়া পাঠাবে পারু, শিরি না নূরজাহান?’

স্তম্ভিত হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলে জোলেখা বলে, ‘আপনার বোনেরা এক–একজন এক দিন করে খাবার পাঠান।’ আমি ভাবি, আমার বোনেরা সবাই সচ্ছল, রীতিমতো বিত্তশালী, তারপরও পালা করে? তবু ওরাই তো আব্বাকে দেখছে, আমরা দেখিনি। আমরা আমাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পরিবার নিয়ে স্বার্থপরের মতো ব্যস্ত থেকেছি, সংসারের অনিয়মে। মা–বাবার প্রতি রয়েছি নিরাসক্ত, নির্লিপ্ত ও উদাসীন। হয়তো প্রকৃতির নিয়মেই মেয়েরা মা–বাবার প্রতি আজীবন থাকে পরম যত্নশীল।

আমি জিজ্ঞেস করি, ‘পাশের বাড়ির আমার ছোট ভাইয়ের বাসা থেকে খাবার আসে না?’ জোলেখা মাথা নিচু করে থাকে। জবাব দেয় না। আমি লজ্জায়, অনুশোচনায় ও অপরাধবোধে ক্ষতবিক্ষত ও দগ্ধ হই। কর্তব্য পালনে আমাদের অমার্জনীয় অপারগতায়, সীমাহীন অকৃতজ্ঞতায়।

কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। আব্বা আর্থিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনেক আশা নিয়ে তাঁর পাঁচ ছেলে ও চার মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। তাঁর এক ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অন্য ছেলে মিন্টো রোডের অভিজাত ও কুলীন সচিবপাড়ার বাসিন্দা ও স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক। আরেক সন্তান বিলেতে লব্ধপ্রতিষ্ঠ শল্যচিকিৎসক, সর্বকনিষ্ঠ একজন অতিপরিচিত স্থপতি এবং আমি অধম একজন সাবেক পাতি কূটনীতিবিদ। মানুষটি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে আমাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন।

আমরা সবাই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, কিন্তু কেউ-ই মানুষ হতে পারিনি। অপরিণামদর্শী আমার ‘নির্বোধ’ আব্বা তাঁর শেষ সম্বল ধানমন্ডির এক বিঘা জমিটি—যার বর্তমান বাজারমূল্য নিদেনপক্ষে ১০০ কোটি টাকা—ছেলেমেয়েদের অকাতরে দান করে গিয়েছিলেন অনেক আগে। জীবনসায়াহ্নে এমন পরিণতি হবে ভাবতেও পারেননি। তাঁর শেষ সম্বলটুকু হাতছাড়া না হলে হয়তো আমরা ভাইবোনেরা তাঁর সেবাযত্ন করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতাম।

মৃত্যুর এক দিন আগে তাঁর কাছে বসতে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আমি দরিদ্র কৃষকের সন্তান। আমার বাবা আমাকে কোনো সম্পত্তি দিয়ে যাননি, দেওয়ার সংগতিও ছিল না। আমি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময় তোমরা সবাই লেখাপড়া করছ। যেখানে প্রতিদিনের ভাত-কাপড় জোগাড় করতে পারি না, সেখানে জমি কিনে বাড়ি করা ছিল অলীক স্বপ্ন। হঠাৎই ধানমন্ডির এক বিঘা জমি আমার নামে বরাদ্দ হলো। তোমার মা এ বাড়ি-ও বাড়ি থেকে ঋণ করে জমির দাম ৫ হাজার টাকা জোগাড় করলেন। এই সম্পত্তি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি। আর জমি কেনার লোভ করো না।

জনবহুল দেশে আমাদের স্থানের বড় অভাব। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি তুমি কিনলে অন্যকে বঞ্চিত করবে। তা ছাড়া কতটা জমি মানুষের প্রয়োজন?’ তিনি তলস্তয়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান নিড’–এর উল্লেখ করে গল্পের নায়ক মৃত্যুপথযাত্রী লোভী কৃষক পাহোমের দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে লেখকের শাশ্বত বাণী, ‘জীবনে তো প্রয়োজন কেবল একখণ্ড ছয় ফুট দীর্ঘ ও তিন ফুট প্রস্থ জমি’—উদ্ধৃত করলেন।

জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে তাঁর এ স্পষ্ট উচ্চারণ ও উপদেশ শুনে আমি অবাক বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই সহজ–সরল, ন্যায়নিষ্ঠ অসাধারণ মানুষটা জীবনে যে ঘাত-প্রতিঘাত ও আপনজন থেকে অনাদর, অবহেলা ও অমর্যাদা পেয়েছেন, তার জন্য নেই এতটুকু অভিযোগ বা ঘৃণা। মৃত্যুর সময় আব্বার মুখে ছিল এক অনাবিল স্নিগ্ধ প্রশান্তি। তিনি যেন সব প্রবীণ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার উদ্দেশে বলছেন, ‘তোমরা আমৃত্যু পরনির্ভর, অবাঞ্ছিত জীবনের গ্লানি থেকে নিজেদের রক্ষা কোরো। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হলে চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। এ জগতে কেউ কারও নয়, প্রত্যেকে নিজের তরে।’

প্রবীণেরা বোঝা নয়, মূল্যবান সম্পদ। পরিবারের জন্য অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সম্পদ। দুঃসময়ে সাহস ও ধৈর্যের আশ্রয়। সুমতি ও সুবচনের আকালের সংকটে একমাত্র ভরসা।

সরকার মাসিক ৫০০ টাকা প্রবীণ ভাতা চালু করেছে। তা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দুঃসময়ে তাঁদের প্রতি পরিবারের একটু দৃষ্টিপাত, যত্ন ও সহানুভূতি।

আব্বা প্রবীণদের প্রকৃত চেহারা, যা ভণ্ড ও ভদ্রসমাজের মুখোশ খুলে দিয়েছে। না জানি এই শহরে আজ ঘরে ঘরে কত বৃদ্ধ আব্বা-আম্মা
লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও নিগ্রহের শিকার হয়ে নিভৃতে, নির্জনে, নীরবে দিন অতিবাহিত করছেন। নচিকেতার মর্মস্পর্শী সেই গানটি, ‘আমার ঠিকানা এখন
বৃদ্ধাশ্রম’ মনে পড়ে যায়। চমকে উঠি। আমিও তো এখন বুড়ো হয়েছি।

আবদুল হান্নান, সাবেক কূটনীতিক