হা অভাব, তুই এতই শক্তিশালী?

অভাব–অনটনের কারণে ঘরবাড়ি, জমিজমা, এমনকি ঘটিবাটি বিক্রির কথা শোনা যায়। কিন্তু অনাগত সন্তান বিক্রি! এও কি সম্ভব? মনে হয়, আমাদের পক্ষে বুঝি সবই সম্ভব।

৬ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় হৃদয়বিদারক এ খবর ছাপা হয়েছে। সংসারে অভাবের কারণে একটি এনজিও ও গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার দিনমজুর জাহাঙ্গীর ও তাঁর স্ত্রী রাবেয়া ৬০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সাপ্তাহিক কিস্তিতে এ ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ঋণের টাকা সময় মতো শোধ করতে না পারায় তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। এ ঝামেলা থেকে বাঁচতে একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও আর সন্তানদের রেখে পালিয়ে যান।

ঋণের টাকা শোধ করার আর কোনো উপায় না পেয়ে অনাগত সন্তানকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন রাবেয়া। এলাকার এক নিঃসন্তান দম্পতির (সন্তানের ক্রেতা) কাছ থেকে সংসার চালানোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম নেন। অবশিষ্ট ৩৫ হাজার টাকা নেবেন সন্তান জন্ম নেওয়ার পর। তবে স্বস্তির কথা হচ্ছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে রাবেয়া সন্তান বিক্রির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।

মায়ের কাছে সন্তান অমূল্য ধন। কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে মা তাঁর সেই অমূল্য ধনকে—যে কিনা এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি—মাত্র ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা একটু ভেবে দেখা দরকার।

দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য স্বাবলম্বী হতে অনেক মানুষ স্থানীয় এনজিওগুলো থেকে ঋণ নেন। কিন্তু দেখা যায়, স্বাবলম্বী হওয়ার বদলে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। এমনও দেখা গেছে, একটি এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে আরেকটি এনজিওর নতুন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন। সেই ঋণের বেড়াজাল তাঁদের পক্ষে আর ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। এনজিওগুলোর কিস্তি পরিশোধের ক্রমাগত তাগিদের কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে ঘরের টিনের চাল, ঘরবাড়ি, এমনকি ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ।

এই তো গত বছরের ঘটনা। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার তালুক দামোদরপুর নয়া ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের এনসেনা বেগম এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে আরও ঋণে জড়িয়ে পড়েন। এসব ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় পাওনাদারদের চাপ বাড়তে থাকে। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে নিজের নয় মাস বয়সী সন্তানকে বিষপান করিয়ে হত্যা করে নিজেও বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান।

২০১৫ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চেংখালী এলাকার গৃহবধূ দিলুয়ারা বেগম এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। যে এনজিও থেকে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন, সেখানকার কর্মীরা তাঁকে চাপ ও হুমকি দিচ্ছিলেন। সহ্য করতে না পেরে দিলুয়ারা বেগম আত্মহত্যা করেন। একই কারণে ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেছেন রাজশাহীর দুর্গাপুর পৌর এলাকার সিংগা গ্রামের গৃহবধূ রেজিয়া বেগম (৪৫)। এ রকম ঘটনা আরও ঘটেছে।

মানুষের উপকার করার বদলে এনজিওগুলো এখন যেন গরিবের রক্ত শোষণের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক এনজিও সঠিক নিয়মকানুন অনুসরণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনও দেখা গেছে, কাগজে-কলমে ১০ শতাংশ সুদের কথা বলা হলেও এনজিওগুলো ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। ফলে দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কত দিন চলবে? আর কত দিন আমরা এসব হৃদয়বিদারক খবর পড়ব। এসব দেখার কি কেউ নেই? এসব এনজিওর বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? কী করে তারা দিনের পর দিন এভাবে নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে? সরকারের উচিত এ ধরনের এনজিওর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ কড়া পদক্ষেপ নেওয়া। এনজিও–ব্যাংকগুলোর ঋণদান কর্মসূচিগুলোকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। তবে সরকারকে সবার আগে কৃষি ও শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কাউকে আর অভাবের কারণে ঋণ নিতে না হয়।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক