নির্বাচন সামনে রেখে মোদির পাকিস্তান নীতি

নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স
নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে খারাপ অবস্থায় আছে। এর মধ্যে সম্প্রতি জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যেভাবে পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করলেন, তা সেই সম্পর্ককে আরও তলানির দিকে ঠেলে নিয়ে গেছে।

জাতিসংঘের অধিবেশনের অব্যবহিত আগে যা ঘটে গেছে, তা একেবারেই অনভিপ্রেত। অধিবেশনের ফাঁকে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে বসবেন বলে কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত বৈঠকের ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে ভারত বৈঠকটি বাতিল করেছে। বৈঠকটি বাতিলের কারণ হিসেবে তারা বলেছে, পাকিস্তান লাগোয়া সীমান্তে ভারতের তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন এবং কাশ্মীরের নিহত এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তান ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ভারত বলেছে, এর প্রতিবাদ হিসেবে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে এ বৈঠক বাতিল করেছে।

কিন্তু কথা হলো, সীমান্তে হত্যা নতুন কিছু নয়। এ বছরেই বেশ কয়েকবার সীমান্তে দুই পক্ষেরই লোক মারা গেছে। আর কাশ্মীরি সন্ত্রাসীকে মহিমান্বিত করে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ অবশ্যই দুঃখজনক ও নিন্দনীয় কাজ। তবে এই ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও এক মাস আগে। অর্থাৎ দুই পক্ষের যে বৈঠক ঠিক হয়েছিল, তার অনেক আগেই ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছিল।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ দুই ঘটনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ‘আসল চেহারা’ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতের সাধারণ নির্বাচনের ছয় মাস আগে দিল্লির এ প্রতিক্রিয়া দেখানোয় প্রকারান্তরে দিল্লির তথা বিজেপি সরকারের আসল চেহারা বেরিয়ে গেছে। আসল কথা হলো, নির্বাচনের আগে মোদির সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখাতে চায় না। পাকিস্তানের সঙ্গে সংস্রব রাখাকে তারা রাজনৈতিক সংবেদনশীল ইস্যু বলে মনে করে।

মোদির বিজেপি আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে মুসলমানদের প্রতি বৈরিতা পোষণে যেমন গর্ববোধ করে, একইভাবে পাকিস্তানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন থাকাটাকেও তারা আদর্শ বলে মনে করে। এ কারণে নির্বাচনের আগে নিউইয়র্কে বসে হাসিমুখে পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে হাত মেলালে তাতে মোদির লাভের চেয়ে লোকসান হতো বেশি।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জাতিসংঘের বক্তৃতামঞ্চকেও নির্বাচনী বক্তৃতার স্থল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে একটানা পাকিস্তানের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন।

পাকিস্তানও যে খুব একটা সরলতার পরিচয় দিয়েছে, তা নয়। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ভারতের সন্ত্রাসীরা নাকি পাকিস্তানকে চারপাশ থেকে ঘেরাও করে রেখেছে। তাঁর এ অভিযোগের পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বা বিশ্লেষক মত দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। কোরেশি ২০১৪ সালে পেশোয়ারের স্কুলে সন্ত্রাসী হামলার জন্য ভারতকে দায়ী করেছেন। তবে এ পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিবেদনে ওই হামলার পেছনে পাকিস্তানের নিজ ভূমিতে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী গ্রুপ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান জড়িত বলে তথ্য উঠে এসেছে। পাকিস্তান সরকারের দিক থেকেও আগে তাদেরই দায়ী করা হয়েছে। ভারত সরকার পাকিস্তান সরকারকে যতটা ঘৃণা করে, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা করে এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তারা পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করে নিজেরা ক্ষমতা দখল করতে চায়।  

অন্যদিকে ভারতে নির্বাচনী উত্তাপ শুরু হয়েছে। মোদির সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সামরিক বাহিনীকেও ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করবে বলে মনে হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিজেপি ক্রমাগত সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে ভারতীয় বাহিনীর হানা দেওয়া নিয়ে গর্বসূচক বক্তব্য দিয়ে থাকে।

গত মাসে বিজেপি কাশ্মীরের লাইন অব কন্ট্রোলে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের বার্ষিকী পালন করেছে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে। যদিও এ ধরনের অভিযানে ভারতের কতটা লাভ হয়েছে, তা তর্কসাপেক্ষ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে মোদির অন্যতম অ্যাজেন্ডা হলো পাকিস্তানবিরোধিতা। ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর সেই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই মোদিই এখন ভোটের জন্য পাকিস্তানের চরিত্র হননে মেতেছেন।

এ মুহূর্তে মোদির পররাষ্ট্রনীতি চলছে হঠকারী নীতি মেনে। পরিকল্পিত নীতি মেনে পররাষ্ট্রনীতি চলছে না। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এ হঠকারী নীতি ততটাই প্রকট হয়ে উঠবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী