নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন প্রশ্নে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও নির্বাহী বিভাগের বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য প্রত্যাশিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বর্তমান ইসির কার্যক্রম কিছুতেই সরকারের ধ্যানধারণার বাইরে যেতে পারছে না। সংবিধানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের কথা বলা আছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অভিমত হচ্ছে, এই নির্বাচন যেনতেন প্রকারে সম্পন্ন করলে চলবে না; নির্বাচন মানেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এখন বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন ও এর সদস্যরা মাঝেমধ্যে এমন আচরণ করছেন, যাতে মন্ত্রী কিংবা সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে তাদের ভূমিকা ফারাক করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।

একটি বাছাই কমিটির মধ্য দিয়ে অধিষ্ঠানের পর থেকে এ পর্যন্ত সরকারি দলের সঙ্গে কমিশনারদের স্বার্থের সংঘাতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনে কে এল বা এল না, সেটা তাঁদের দেখার বিষয় নয়। এ ধরনের উক্তি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে বিচারপতি কে এম সাদেকের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকেও আমরা বলতে শুনেছি। এমনকি ২০০৬ সালেও বিচারপতি এম এ আজিজও একই ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। ওই দুটি নির্বাচন কমিশনই আইনের আক্ষরিক ব্যাখ্যানুযায়ী আইন ও সংবিধানসম্মত যুক্তি খাড়া করেছিল।

মনে রাখা দরকার, তারা নির্বাচনী ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। সুতরাং ইতিহাসের বৃহত্তম নির্বাচন কমিশনটির পরিণতি যাতে অভিন্ন না হয়, সে জন্য তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত আচার-আচরণও প্রত্যাশিত। কমিশন অবশ্যই দুই প্রধান দলের রাজনৈতিক কাজিয়া মীমাংসা করতে পারে না। কিন্তু তারা যে বিদ্যমান সংবিধান আইন ও রীতিনীতি কঠোরভাবে অনুশীলন করতে সচেষ্ট রয়েছে, তাতে সরকারি দলের বেপরোয়া আচরণ এবং একতরফা নির্বাচনী প্রচারণা খামোশ করতে না পারা দুর্ভাগ্যজনক।

সিইসি রাজনৈতিক সমঝোতার অপেক্ষায় থাকার কথা বলেছেন। এর বিপরীতে সরকারি দল সমঝোতা ও সংলাপের মুলা দেখিয়ে চলেছে। আর বিরোধী দল হরতালের নামে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। চার দিনের হরতাল শেষে তারা আবার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে। এর ফলে জনজীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্যোগ।

দুই দলের এই যুদ্ধংদেহী অবস্থার মধ্যে ইসির সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি চোখে পড়ে না। এমনকি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা নিয়েও তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে বলে কমিশন দাবি করলেও সেই ব্যবস্থায় নির্বাচনকালীন আচরণবিধি কী হবে, তা এখনো তারা ঠিক করতে পারেনি। কমিশনের এই প্রস্তুতিহীনতা এই সন্দেহ-সংশয়ের জন্ম দিয়েছে যে, তারা আসলে সরকারি দলের নির্বাচনী কৌশলকে সহায়তা দিতে চায়; তাদের পথে বাধা হতে চায় না। এই ধারণা যে সত্য নয়, সেটি প্রমাণ করতেই ইসির কার্যক্রমে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি সরকারের বি টিম হবে, তা কারও কাম্য নয়।