রুপালি গিটারের জ্বালা কি জুড়াল?

যে সুখবর আসার কথা, সেই খবরটা আসে না। যে মানুষটা থাকার কথা, সেই মানুষটা থাকে না। আমাদের ধূসর ঘটনাবহুল গত দশকে কতজন চিদাকাশের তারা হয়ে গেল...মানুষটাসুদ্ধ গান হয়ে গেল মৃত্যুতে। স্মৃতির ধূপে চোখ জ্বলল, ঝাপসা হলো একটু। বিদায় আইয়ুব বাচ্চু, বিদায় ব্যান্ডগানের রুপালি দুঃখের সাধক। মরার দেশে জীবন জীয়ে না কেন?

এ রকমই এক হেমন্তের সকালে সাউন্ডবক্স ঘরের জানালায় ঠেকিয়ে বাড়ির সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে তাঁর গান শুনছিলাম: এই রুপালি গিটার ফেলে...। কখনো হেমন্তের রাতে বাজত ‘এখন অনেক রাত’। তাঁর কণ্ঠ কাঠকাঠ আবার ভেজাভেজা। সবল অথচ আবেগী। শুনতাম আর চালের ওপর ডেউয়াফল খসে পড়ত। ঘরের ভেতর দুই সাউন্ডবক্সঅলা চ্যাঞ্জারে খয়েরি ফিতেঅলা ক্যাসেট ঘুরত। মফস্বলে গানের আওয়াজ অনেক দূর ছড়ায়, গাড়ির আওয়াজে বা আরেক বাড়ির দেয়ালে বাধা পেত না। হয়তো পাশের বাড়ির মেয়েটিকেও শোনাতে চাইতাম সেই গান।

আইয়ুব বাচ্চুর এলআরবি ব্যান্ড বন্ধুদের কাউকে গায়ক করল, কেউ ময়না রেকর্ডিং থেকে হাতখরচ বাঁচানো টাকায় টি ডি কে ক্যাসেটে বাছাই গান রেকর্ড করে লুকিয়ে বান্ধবীকে দিতে চাইত। পয়সা সঞ্চয় হলেও দেওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে বন্ধুদের সভা বসাতে হতো। সেখানেও হয়তো সুমন, হয়তো শাওন আসত গিটার হাতে…চিৎকার করে গাইত, ‘বোঝে না কেউ তো চিনলা না, বোঝে না আমার কী ব্যথা’।

সেবার ঢাকায় এলাম। প্রথম জিনস পরতে শিখেছি। এলিফ্যান্ট রোডে, সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় ঘুরি। মনে হয় এটা বুঝি ব্যান্ডের শহর, সোলস, এলআরবি, ফিডব্যাক, মাইলস, চাইম, ওয়ারফেজের শহর। তখনো জানতাম না বাচ্চু চট্টগ্রামের মানুষ। জানতাম না, চট্টগ্রামের ছেলেরা শুধু ক্রিকেটে নয় একসময় জাতীয়ভাবে কত বিখ্যাত ব্যান্ডের জন্ম দিয়েছে। আমাদের স্বল্পায়ু নগরসভ্যতার অবদান ছিলেন তাঁরা।

আমাদের নব্বই দশক, যখনও আমরা বিশ্বায়িত দূরের কথা, জেলা শহরটাকে ছাপিয়ে যেতে পারিনি। আমরা যারা কেবল হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছি, গোঁফ কেবল গজাচ্ছে যেন পেনসিলে আঁকা—তাদের মনকে শাণ দিত এসব গান। সে সময়ের ব্যান্ডের গানে তারুণ্যের দমক তোলা রাগ–কান্না–হতাশা ছিল, ছিল জোয়ারের মতো এক অবুঝ ভালোবাসা। এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে ভাবি, কত ইনোসেন্ট, কত উচ্ছল, কত প্রাণাবেগে কেঁপেছি।

বাদক, বাদনের তুঙ্গে উঠে কী তুমি গাইতে চেয়েছিলে? এই অকালে কে তোমাকে এভাবে বাজিয়ে শেষ করে দিল হঠাৎ? আমাদের প্রথম যৌবনের মনে তোমার গানের সিলমোহর মারা ছিল। আজ কত–কী বুঝি, কত–কী বুঝি না; কিন্তু তোমার বিদায়ের দিনে ঠিক টের পাই, আমরা তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমাদের মনের জেদ তোমার কণ্ঠের মতো সবল। আর বুঝি, তোমার মনটা নারকেলের মতো, ওপরে যতই কঠিন দেখাক, ভেতরটা তরল–কোমল–সরস ও শুভ্র।

এলআরবির বাচ্চু ভাইয়েরা একা আসেননি। তাঁর সময়ের ব্যান্ডগুলো—সব মনেও নেই—মাকসুদের ঢাকা, মাইলসের দুই ভাই, গুরু জেমস…লাকি আখ্‌ন্দ যাঁদের সুরের মার্টায়ার বীর, তাঁরা একটা সুন্দর বসন্ত নিয়ে এসেছিলেন। হিন্দি গানের জোয়ার হয়তো তাঁরাই ঠেকিয়ে রাখছিলেন। সেসব কি অনেক আগের দিন, অনেক দূরের সময়? দূরেরই, নইলে আইয়ুব বাচ্চু এভাবে রুপালি গিটার ফেলে সুদূর হলেন কেন?

আগে কাউকে দেখলে বলতাম, ‘কেমন আছেন?’ এখন বলি, ‘বেঁচে আছেন?’ বিদায়ের সময় ‘ভালো থাকবেন’ বলি না; বলি ‘বেঁচে থাকবেন!’ ভালো না থাকি, বেঁচে যেন থাকি। আমাদের সময়ের নায়কেরা সময়কে ধাক্কা দিয়ে চলে না যাক। অসময়ের যাত্রীদের আমরা কেন ঠেকাতে পারছি না। তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের ওভাবে চলে যাওয়া মানা যায়? চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরও অপঘাতে মারা গেছেন। অপঘাতে নিহত শহীদ জহির রায়হানের লাশটাও মেলেনি। হুমায়ুন আজাদ বাঁচতে পারেননি। অপঘাত থামিয়ে দিয়েছিল চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকেও। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও অকালে চলে গেলেন। এ রকম কত কত…

অভিমান থাকবেই শিল্পীর। জীবনের গরল তার আত্মাকে পোড়ায়, সেই পোড়া মন থেকেই আসে অমন স্পর্শকাতর ভাষা ও সুর। নিজের প্রতি অভিমান, চরিতার্থ না হওয়া স্বপ্ন, না–পাওয়া প্রেম আর ফুরিয়ে ফেলা আয়ুর প্রতি অভিমান। কিন্তু যারা বেঁচে থাকি, তাদের মন ছোট হয়ে যায়, তাদেরও অভিমান হয় যে, আমাদের স্মৃতির–স্বপ্নের একটা অংশ আমরা হারিয়ে ফেললাম। যে যায়, সে একা যায় না, আমাদের আত্মার একটা অংশকেও সঙ্গে নিয়ে যায়।

পিঞ্জর ছেড়ে পাখি উড়ে গেলে আকাশে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, দূর থেকেই তাঁকে এখন শোনা যাবে ভালো। আমাদের ধূলিবর্ণ দশক, আমাদের রোদজ্বলা দুপুর, আমাদের কৈশোরক কুয়াশাও আরও দূরে চলে গেল। হ্যাঁ রে মনা, দূর থেকেই আবার তাঁকে শোনার দিন এল। রুপালি গিটারের জ্বালা কি তবু জুড়াল?

বিদায়ের সময়ই মানুষ বুঝতে পারে তার সত্যিকার ভালোবাসা। বিদায়ের সময়ই টের পেলাম, বুকের ভেতর ঝুরঝুর করে মাটি ঝরার মতো শোক ঝরছে।

ফেরারী তাঁর মনটা নাকি কিসের সন্ধানে বারবার ফিরে আসবে। কিন্তু যা যায়, তা আর ফিরে আসে না, গরিলা গ্লাসের মতো উত্তরাধুনিক মনে কোনো দাগই স্থায়ী হয় না। আপনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদেরও কিছুটা হারিয়ে ফেললাম; আজম খানের ভাষায়, ‘হারিয়ে গেছে ফিরে পাব না’। কষ্টটা সে জন্যই।