সংকট মোকাবিলায় তিনটি অবস্থান

>একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। গঠিত হচ্ছে নতুন নতুন জোট। জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজের তিন কিস্তির লেখার দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশ হলো আজ।

গত রোববার ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ও অ্যাজেন্ডা ২০৩০: তারুণ্যের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সম্মেলনে ‘নির্বাচনে সুশাসন: তরুণদের ভূমিকা’বিষয়ক প্যানেল আলোচনার পর তরুণেরা যেসব প্রশ্ন করেছেন সেসবের মধ্যে এমন প্রশ্নই ছিল বেশি: ‘নির্বাচন হবে তো? আমার ভোটটা আমি দিতে পারব তো?’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই অনুষ্ঠানের একজন আলোচকের দেওয়া এই তথ্য আমাদের বিস্মিত করে না। কেননা, দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থা এসব প্রশ্নের নির্ভরযোগ্য উত্তর দিতে পারছে না। মোট ভোটারের সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১; এর প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ, প্রায় সোয়া ২ কোটি তরুণ প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন গত ১০ বছরে। নির্বাচন, যাকে গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ বলে বিবেচনা করা হয় এবং যা রাজনীতিবিদদের একধরনের জবাবদিহির সম্মুখীন করে, তা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের সংশয় সুস্পষ্ট।

যে রাজনৈতিক সংকট এই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তার মোকাবিলায় দেশের রাজনীতিতে তিনটি অবস্থান তৈরি হয়েছে। সেসব অবস্থানের আলোকেই আসন্ন নির্বাচন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্ন বিবেচিত হচ্ছে।

প্রথমটি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের। তারা কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখছে না, কেননা বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীনদের জন্য এখনো কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেনি। ফলে তারা মনে করে নির্বাচন সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা হিসেবে সম্পাদন করা দরকার। তারা দেখাতে চায় যে নির্বাচন মানে ক্ষমতার হাতবদল এবং তাদের বিকল্প হচ্ছে বিএনপি, যার ক্ষমতায় আসা রোধের জন্যই ক্ষমতাসীন জোটের বিজয়ী হওয়া দরকার। নির্বাচনের যে ব্যবস্থা এখন বহাল আছে তাতে তারাই বিজয়ী হবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু তারা এটা নিশ্চিত করতে যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণেই উৎসাহী। তারা বিজয়ী হয়ে বর্তমান শাসনব্যবস্থা বহাল রাখতে চায়, যার অন্যতম দিক হচ্ছে শক্তি প্রয়োগের ধারা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতি। বাম গণতান্ত্রিক জোটের ভাষায় এটা হচ্ছে ‘স্বৈরতান্ত্রিক দুঃশাসন-জুলুম-লুটপাটের’ ব্যবস্থা। ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে তাঁরা মনে করেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দৃশ্যমান সাফল্য ও কথিত বিকল্পের অনুপস্থিতির কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাঁদের সঙ্গেই আছেন।

দ্বিতীয় অবস্থানটি হলো এই বিবেচনা যে আসন্ন নির্বাচন হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা এবং বিরাজমান হাইব্রিড বা দোআঁশলা শাসনব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম পদক্ষেপ। এটা একটি অনিবার্য পদক্ষেপও। এই বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই কমবেশি সব বিরোধী দলের দাবিনামাগুলো প্রণীত হয়েছে এবং ‘জাতীয় ঐক্য’ গঠনের তাগিদ তৈরি হয়েছে। বিরোধী দলগুলো সম্মিলিতভাবে বা এককভাবে এমন একটা নির্বাচনের দাবি করছে, যেখানে সবার অর্থবহ অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে, ভোটারদের ‘আমার ভোটটা আমি দিতে পারব তো?’ প্রশ্নের উত্তর থাকবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতার ব্যবস্থা থাকবে। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন ফলাফলের যে অনিশ্চয়তা থাকে, অর্থাৎ কে জিতবে কে হারবে তার নিশ্চয়তা থাকে না, তা বিদ্যমান থাকবে; বিরোধী দলগুলোর পক্ষে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হবে। এই লক্ষ্যে নির্বাচনে-আন্দোলনে কোন শক্তিগুলো থাকবে, কে কার সঙ্গে থাকবে, কে কতটুকু ছাড় দিয়ে থাকবে, একই ধরনের দাবি যারা তুলছে তাদের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক থাকবে সেগুলো এখনো অস্পষ্ট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রকমের টানাপোড়েন তার লক্ষণ। তবে আসন্ন নির্বাচনকে কেবল ক্ষমতার হাতবদলের বিষয় হিসেবে দেখার সুযোগ নেই সেই ধারণা ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে; অন্ততপক্ষে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, এই ধরনের উদ্যোগ বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে সম্ভব কি না। আমাদের বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে এমনকি সাম্প্রতিক সরকারি ভাষ্য অনুযায়ীও বিএনপির ভোটের পরিমাণ ৩০ শতাংশ। এই অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় দল হিসেবে, অতীতে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে, ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাবহির্ভূত অবস্থায় অগণতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপের প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তার সঙ্গে জোটের অন্য শরিকদের সম্পর্ক কী হবে সেটা এবং তাদের দলের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব বিষয়েও প্রশ্ন আছে। কিন্তু বিএনপির নেতাদের জন্য অন্যতম সিদ্ধান্তের বিষয় হচ্ছে তাঁদের কাছে প্রাধান্য পাবে কোনটা—ক্ষমতার হাতবদলের প্রশ্ন, তাঁদের ভাগ্যবদলের চেষ্টা, নাকি বিরাজমান ব্যবস্থার অবসানে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপে যুক্ত হয়ে তাকে সহযোগিতা করা, এমনকি তার জন্য বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করার প্রশ্ন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে শরিক হওয়া এই বিষয়ে তাদের অবস্থানের একধরনের ইঙ্গিত দেয় কিন্তু ভবিষ্যতে এই বিষয়ে বিএনপির আন্তরিকতার দিকেই সবার নজর থাকবে। একই সঙ্গে এই ধরনের প্রচেষ্টায় শামিলদের মনে রাখতে হবে যে তারা বিএনপির হয়ে মাঠে নেমেছে এই প্রচারণা তাদের মোকাবিলা করতে হবে। নির্বাচন শুধু উল্লম্ব (ভার্টিক্যাল) জবাবদিহির সুযোগ তৈরি করে, কিন্তু আনুভূমিক (হরাইজন্টাল) জবাবদিহির নিশ্চয়তা ছাড়া গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব, সেটা তাদের মনে রাখতে হবে।

তৃতীয় অবস্থান হচ্ছে, যারা মনে করে বিরাজমান শাসনব্যবস্থায় অগণতান্ত্রিক উপাদানগুলো প্রধান হয়ে উঠলেও এবং তাদের ভাষায় ‘স্বৈরতান্ত্রিক দুঃশাসন-জুলুম-লুটপাটের’ শাসন চললেও নির্বাচন যেহেতু ক্ষমতার হাতবদলের বিষয়ও, সেহেতু যতক্ষণ না এটা নিশ্চিত হচ্ছে যে অতীতের বৃত্তচক্রের পুনরাবৃত্তি হবে না—অর্থাৎ বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখা। বিএনপির ক্ষমতায় আসা বা না–আসার বিষয়টি কেবল তখনই ওঠে, যখন সবার অংশগ্রহণমূলক একটি স্বচ্ছ অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই আশঙ্কা বা সম্ভাবনা তিরোহিত করতে গিয়ে সবার অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি থেকে তারা সরে যায়নি। যেকোনো ধরনের ঐক্যপ্রক্রিয়া যাতে বিএনপি যুক্ত তাতে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের আপত্তি রয়েছে। বাসদ-সিপিবিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের অবস্থানের মোদ্দা কথা এটাই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিকল্পধারার যোগদান না করার যেসব কারণ বলা হচ্ছে তার একটি বক্তব্য এই রকম, যদিও সেটাই কারণ কি না তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই নিশ্চয়তার চেয়ে দোআঁশলা ব্যবস্থার অবসানে সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখা গুরুত্বপূর্ণ কি না এবং আসন্ন নির্বাচনকে তারা সেভাবেই বিবেচনা করে কি না। সে সম্মিলিত প্রচেষ্টার রূপ কী হবে, সেটা সংশ্লিষ্টদের বিবেচ্য বিষয়।

এই তৃতীয় অবস্থানে যারা আছে তাদের অবস্থানকে একেবারে নাকচ করে দেওয়া অসমীচীন। কিন্তু তাদের এটা স্পষ্ট করতে হবে যে তারা বিরাজমান সংকটকে প্রধান সংকট মনে করে কি না; যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বা ওই ধরনের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে তারা নাকচ করে দিয়েছে, সেহেতু পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতিকে বর্তমান পরিস্থিতির চেয়েও বিপজ্জনক মনে করে কি না, সেটা তারা নিশ্চয় ভেবেছে। কেবল ইতিহাস নয়, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি তারা নিশ্চয় বিবেচনায় রাখছে। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের যে সংকট তা নিয়ে আলাপ–আলোচনায় গণতন্ত্রের বিভিন্ন রকমের ত্রুটি আলোচিত হচ্ছে, কিন্তু গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমালোচকেরাও এটা স্বীকার করছেন যে সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রেও মানুষের ভুল সিদ্ধান্ত বদলের এবং ভুল নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে; এখন পর্যন্ত অন্য কোনো শাসনব্যবস্থায় তার সুযোগ আমরা দেখতে পাইনি।

আসন্ন নির্বাচনের প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এই তিনটি অবস্থান হচ্ছে আজকের বাস্তবতা। ভবিষ্যতে নাটকীয় পরিবর্তন না ঘটলে এই সব অবস্থানই নির্ভর করবে নির্বাচনের আগে পর্যন্ত কী ঘটবে, কী ধরনের নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের পরে রাজনীতির পথরেখা কী হবে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

আগামীকাল পড়ুন: নতুন মেরুকরণে কে কোন দিকে