আনন্দ বিনোদন সুন্নত ইবাদত

ইসলামের উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ায় শান্তি ও পরকালে মুক্তি। তাই ইসলামের বিধান জীবনব্যাপী। সুখী জীবনের জন্য চাই আনন্দ ও বিনোদন। নীরস নিরানন্দ জীবন হতাশা তৈরি করে। হতাশা জীবনের ব্যর্থতার কারণ। বিনোদন হলো আনন্দের মাধ্যম বা উপকরণ। মানসিক প্রশান্তির জন্য যা করা হয় তা-ই বিনোদন।

নিঃসঙ্গতা মানবজীবনের অন্যতম সমস্যা। হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে যখন জান্নাতে রাখা হলো, তখন তিনি একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার সমস্যায় পড়েন। তাঁর এই সমস্যা সমাধানে আল্লাহ তাআলা হজরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। শুরু হয় মানবসভ্যতার যৌথ পথচলা। মানুষ সামাজিক জীব, তাই সে নিঃসঙ্গ বা একাকী জীবন ধারণ করতে পারে না। নিষ্পাপ আনন্দ ও বৈধ বিনোদন সুন্নত। বিনোদনের উপায় উপকরণগুলোর প্রায় সবই প্রিয় নবীজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম প্রয়োগ ও উপভোগ করেছেন। যেমন: গল্প, কৌতুক, হাস্যরস, খেলাধুলা, কবিতা আবৃত্তি, পদ্য প্রণয়ন, গদ্য পাঠ, সাহিত্য রচনা, সংগীত ইত্যাদি। আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) কুস্তিও লড়েছেন। তৎকালীন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরকে তিনি তিন-তিনবার হারিয়েছেন। মদিনায় যুবকদের শারীরিক কসরত তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন। হজরত আয়েশা (রা.)–ও ঘরে বসে তা উপভোগ করেছেন। রাসুল (সা.) বিবি আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে একাধিকবার দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন।

শৈশবে নবীজি (সা.) খেলাধুলায় নেতৃত্ব দিতেন। কৈশোরে হুজুরে পাক (সা.) প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করতেন। তরুণ বয়সে তিনি তরুণ সংঘ গড়ে তোলেন। যুবক বয়সে তিনি সমাজসেবামূলক কর্মে অংশগ্রহণ করেন। রাসুল (সা.)-এর রচিত কবিতা বুখারি শরিফসহ সিহাহ সিত্তাহ ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে উল্লেখ আছে। যেমন: ‘আনা নাবিউন লা কাযিব, আনা ইবনু আবদিল মুত্তালিব।’ অর্থ: আমি নবী মিথ্যা নই, আমি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র হই। (সিরাতে ইবনে হিশাম)।

নবীজি (সা.) কাব্য পছন্দ করতেন। হজরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) ভালো কবিতা রচনা করতেন এবং চমৎকার আবৃত্তি করতেন। রাসুল (সা.) তাঁর জন্য মদিনা শরিফে মসজিদে নববিতে আরেকটি মিম্বার বানিয়ে দিলেন। যেখান থেকে তিনি তাঁর কাব্য উপস্থাপন করতেন। প্রিয় নবীজি (সা.) ভালো শ্রোতাও ছিলেন। তিনি হজরত হাসসান (রা.)-এর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে নিজের গায়ের চাদর তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

আনন্দ-বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো সংগীত। প্রিয় নবীজি (সা.) প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে যখন মদিনায় গেলেন এবং দীর্ঘ দুই সপ্তাহের অবিরাম সফরের ক্লান্তিতে মলিন বদনে এক উষালগ্নে যখন সেখানে পৌঁছান; তখন মদিনার ছোট ছেলেমেয়েরা অভ্যর্থনা সংগীত গেয়ে প্রিয় নবীজি (সা.)-কে স্বাগত জানায়। (ইসলামি বিশ্বকোষ)। যুদ্ধ জয়ের পর বালিকারা নবীজি (সা.)-কে দফ (বিশেষ বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে গান গেয়ে বরণ করত। একবার নবীজি (সা.) সফরে থাকা অবস্থায় হজরত আয়েশা (রা.) এক দাসীকে বিয়ে দিলেন। নবীজি (সা.) সফর থেকে ফিরে এসে জানতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন: তার বিয়েতে কি আনন্দ অনুষ্ঠান করেছ? হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, না। নবীজি (সা.) বললেন: কেন করোনি? (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) হাজারো দুঃখ-কষ্টেও হাস্যরস ও কৌতুক করেছেন। একদা নবীজি (সা.) কয়েকজন সাহাবিসহ খেজুর খাচ্ছিলেন। প্রত্যেকে খেজুরের বিচি যাঁর যাঁর সামনে রাখছিলেন। নবীজি (সা.) তাঁর খেজুরের বিচি হজরত আলী (রা.)-এর সামনে (তাঁর খেজুরের বিচির সঙ্গে) রাখতে লাগলেন। খেজুর খাওয়া শেষ হলে দেখা গেল সবার সামনে প্রায় সমপরিমাণ খেজুরের বিচি; কিন্তু হজরত আলী (রা.)-এর সামনে দ্বিগুণ খেজুরের বিচি এবং নবীজি (সা.)-এর সামনে কোনো বিচিই নেই। এবার নবীজি (সা.) বললেন: আলী! তুমি তো দ্বিগুণ খেজুর খেয়েছ। হজরত আলী (রা.) তখন বললেন, আমি হয়তো খেজুর বেশি খেয়েছি; কিন্তু খেজুরের বিচি খাইনি; আপনি তো খেজুরের বিচিসহই খেয়ে ফেলেছেন। (নবী সা. জীবনী)। সহাস্য বদনে থাকা ও হাসিমুখে কথা বলা সুন্নত। রাসুল (সা.) সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে থাকতেন। হাদিস শরিফে রয়েছে: ‘কোনো মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলে, হাসিমুখে কথা বলা সদকা করার সমান সওয়াব।’ অর্থাৎ দানে যেমন পুণ্য হয় ও আত্মা পবিত্র হয় এবং প্রশান্তি লাভ করে; অনুরূপ হাসি দ্বারা পুণ্য অর্জন হয়, মন পরিষ্কার হয় ও শান্তি লাভ হয়। (শামায়েলে তিরমিজি শরিফ)।

ইসলাম মানুষের সুকুমার বৃত্তির ইতিবাচক বিকাশ ও কল্যাণকর প্রকাশ চায়; যা তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। ইসলামে বিনোদনের ক্ষেত্রে যে বিষয় লক্ষ রাখা হয় তা হলো কল্যাণকর ও প্রশান্তিদায়ক হতে হবে। যে আনন্দ বেদনার কারণ হয়, তা প্রকৃত আনন্দ নয়। যে সুখ দুঃখের কারণ হয়, তা প্রকৃত সুখ নয়। জ্ঞানচর্চা, সমাজসেবা ও মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়া সর্বোত্তম বিনোদন। 

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com