চক্ষুলজ্জাও মরে যাচ্ছে দৃশ্যদূষণে

ভারতের প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ একটি টেলিভিশন চ্যানেলে ‘ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে এক আলাপচারিতার অনুষ্ঠান করতেন। অনুষ্ঠানে অতিথিদের সঙ্গে তাঁর নানা বিষয় নিয়ে কথা হতো। এই ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানিতে একবার এসেছিলেন অভিনেত্রী অপর্ণা সেন ও তাঁর স্বামী কল্যাণ রায়। কল্যাণ রায় নিউ জার্সিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক নাটক পড়ান। শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি প্রায় প্রতিবছর গ্রিসে যান। সেখানে প্রাচীন ইপিদাউরুস থিয়েটার আছে। সেখানে নিয়ে তাঁদের গ্রিক থিয়েটার সম্পর্কে ধারণা দেন। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে বানানো এই থিয়েটারে সফোক্লিসের ট্র্যাজেডি মঞ্চায়িত হতো।

অনুষ্ঠানে কল্যাণ রায় বলছিলেন, নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে গ্রিস সরকারের সংবেদনশীল মনোভাব তাঁকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। ইপিদাউরুস থিয়েটারের সৌন্দর্য ও আদি সৌকর্য যাতে বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য গ্রিস সরকার আশপাশে কোনো ভবন বা উঁচু স্থাপনা তুলতে দেয়নি। সেখানে আশপাশে বিশাল জায়গা। চাইলেই দশতলা–বিশতলা ভবন তুলে মোটা আয়রোজগারের পথ করা যায়। কিন্তু তারা ভবন তোলেনি। কারণ, ভবন তুললে দূরের পাহাড়-বনস্থালি দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যাবে। চোখের আরাম নষ্ট হবে।

থিয়েটারটি যাতে কোনো রকম দৃশ্যদূষণের শিকার না হয়; দর্শনার্থীরা সেখানে গেলে যেন প্রাচীন থিয়েটারের সৌন্দর্য অবিকৃতভাবে খুঁজে পান, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। তার মানে তারা মানুষের চোখের স্বস্তির কথা ভেবেছে। তারা দৃষ্টির আরামের কথা ভেবেছে। যে জাতির মধ্যে এই ভাবনা কাজ করে, তাদের কাছে দৃশ্যদূষণ কত বড় গর্হিত কাজ তা আন্দাজ করা যায়।

আমাদের এমনই কপাল পোড়া যে, এ দেশে দৃশ্যদূষণ নিয়ে কথা বলতে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। এ নিয়ে বলতে গেলেই কেউ হয়তো মহা বিরক্ত হয়ে বলে বসবে, ‘ধুর মিয়া!, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, খাদ্যে ভেজাল—এই সবের ঠেলায় জান বাঁচে না। আপনি আসছেন দৃশ্যদূষণ নিয়ে! গরিবের ঘোড়া রোগ!’

কথা হলো এটি ‘ঘোড়া রোগ’ হোক আর ‘হাতি রোগ’ হোক—এই রোগ যে মারাত্মক একটি রোগ, তা সবাইকে বুঝতে হবে।

চোখের সামনে যা দেখি সেটাই দৃশ্য। যা দেখে চোখের আরাম হয়, তা মস্তিষ্কেও স্বস্তি আনে। সেই দৃশ্য হয়ে ওঠে ‘দর্শনীয়’। জগতের সব দৃশ্য দর্শনীয় নয়। কিছু দৃশ্য বর্জনীয়। যে দৃশ্য চোখের আরাম নষ্ট করে, মনের শান্তি ধ্বংস করে এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীর অসুস্থ হয়, সেই দৃশ্য অস্বাস্থ্যকর। সেই দৃশ্য দৃষ্টিকটু। তা শরীর ও মনের জন্য পীড়াদায়ক।

আমাদের এই পোড়া দেশের চোখগুলো সম্ভবত কোনটি দৃষ্টিনন্দন আর কোনটি দৃষ্টিকটু, তা বিচার করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে।

অনেক খরচাপাতি করে রাজধানীতে সুন্দর সুন্দর উড়ালসেতু বানানো হলো। সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিপাটি করে সেতুগুলোর উদ্বোধন করা হলো। ১০ দিন না যেতেই দেখা গেল একেকটি উড়ালসেতু একেকটি বিজ্ঞাপন বোর্ড হয়ে গেল। শত শত পোস্টার, শত শত চিকা, অসংখ্য ব্যানার, অগণিত সিল–ছাপ্পড়ে উড়ালসেতুর ঝকঝকে–তকতকে পিলার ভরে গেল। ঈদ উপলক্ষে এলাকাবাসীকে অমুক ভাইয়ের শুভেচ্ছা, তমুক বড় ভাই অমুক দলের তমুক পদ পাওয়ায় অমুক ছোট ভাইয়ের অভিনন্দন—এই রকমের পোস্টার একটার ওপর একটা লেগে গেল। এর সঙ্গে অমুক খান অভিনীত অশ্রুসজল অ্যাকশন ছবির পোস্টার তো আছেই। সেই পোস্টারে রক্তমাখা ছুরি হাতে দাঁত–মুখ খিঁচিয়ে থাকা নায়কের ভিলেন–মার্কা ছবি। তার পাশেই হয়তো আছে ‘অবাধ্য স্বামী/স্ত্রী বাধ্য করার’ কায়দা বাতানো বিজ্ঞাপন। ধর্মীয় বক্তব্যসংবলিত পোস্টারের পাশেই চেখে পড়বে ‘ব্যথামুক্ত’ খতনা করার হাজামের নামসহ তাঁর মোবাইল নম্বর। আয়ুর্বেদিক ও ইউনানিমতে চিকিৎসা দেওয়ার দাওয়াখানার বিজ্ঞাপনের ছবি ও লেখার দিকে দৃষ্টি ফেলাও অনেকের জন্য বিব্রতকর। পাবলিকের জন্য তা যতই বিব্রতকর হোক না কেন, নগর কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রশাসনের কাছে তা ততটা অস্বস্তিদায়ক নয়। এসব দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে, কিন্তু এসব অপসারণে অভিযান চালানোর দৃশ্য আমাদের ভাগ্যে নেই।

রাস্তার দুই পাশের দেয়ালগুলোতে একই ধরনের লেখা, একই ধরনের পোস্টার দেখা যায়। অবধারিতভাবে ভুল বানানে দেয়ালের যে জায়গাটায় লেখা থাকে, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’, সেই লেখার ওপরেই সাধারণত লোকজনকে অবলীলায় মূত্রপাত করতে দেখা যায়। সেদিকে কারও চোখ যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে তাদের কোনো বিকার নেই।

ধরা যাক আপনি কারওয়ান বাজারে ঢুকলেন। নিচের দিকে তাকান। দেখবেন রাস্তায় ‘আমের খোসা ও আঁটি, কাঁঠালের ভূঁতি, মাছের কানকা, মরা বিড়ালের ছানা—ছাইপাঁশ আরও কত–কী যে!’ এবার ওপরে তাকান, দেখবেন, মাথার ওপর কত হাজার পদের তার প্যাঁচানো। টাঙানো দড়িতে ঝোলা নানা কিসিমের পোস্টার আপনার মাথায় মুখে চামর দোলাচ্ছে। অজস্র পদের নেতার সংগ্রামী শুভেচ্ছা বার্তায় আপনার আকাশ ঢেকে গেছে। আপনার দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে।

রাস্তা বা ফুটপাতে জঞ্জাল, ময়লা, সুয়ারেজের উপচে পড়া বিষ্ঠা দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সাদা চোখে মনে হচ্ছে এগুলো আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। মন সওয়াও হয়ে গেছে। কিন্তু চোখ বুজে একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, আমাদের চক্ষুলজ্জা কমতে কমতে এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে যে দৃশ্যদূষণকে এখন আর আমরা কোনো দূষণই মনে করি না। এগুলোকে আমরা অর্থহীন উন্নাসিকতায় পশ্চিমা সাহেবদের ভদ্দরলোকি বিলাস ভাবি। এ কারণেই ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’—গাওয়ার সময় এই অভব্য দৃশ্য আমাদের মগজের প্রেক্ষাগৃহে ফুটে ওঠে না। কারণ আমরা খাঁচার পাখি হয়ে গেছি। খাঁচার বদ্ধ জীবনই আমাদের আসল জীবন হয়ে উঠেছে। ওড়ার আনন্দ আমরা ভুলে গেছি। বনের পাখি যখন বলছে, ‘আপনা ছাড়ি দাও/মেঘের মাঝে একেবারে’, ঠিক তখন আমরা খাঁচার পাখি হয়ে বলছি, ‘নিরালা সুখকোণে/বাঁধিয়া রাখো আপনারে!’

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জে্যষ্ঠ

সহসম্পাদক