বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান

মাসজুড়েই জন–আলোচনায় ছিল ‘ঐক্য প্রক্রিয়া’। নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলো ততই নড়েচড়ে বসছে। কয়েক দশক ধরেই রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে ঘিরে। এর বাইরে অন্য দলগুলো তেমন কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারেনি। কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ কয়েক বছর ধরেই চেষ্টায় ছিলেন রাজনীতির দুই পরাশক্তির বাইরে তৃতীয় স্রোত তৈরি করার। সেটি হয়নি। একপর্যায়ে এসে তাঁদের বোধোদয় হলো বড় একটি দলের সঙ্গে না থাকলে রাজনীতির মঞ্চে দৃশ্যমান থাকা যাবে না। এটাই বাস্তবতা।

এর মধ্যে কাদের সিদ্দিকী কিছুটা আলাদা হয়ে গেলেন। বাকিরা জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা জারি রাখলেন। তৈরি হলো দুটি ছোট জোট। কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াআর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের যুক্তফ্রন্ট। এই দুই জোট মিলে একটি বড় জোট গড়তে চাইল। সঙ্গে এরা চাইল বিএনপিকে, কেননা, বড় একটি দল সঙ্গে না থাকলে রাজনীতিতে গুরুত্ব থাকে না।

এত দিন গুঞ্জন ছিল, জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে বিএনপি এদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হবে কি না। শেষমেশ দেখা গেল, বিএনপির সঙ্গে কামাল-রব-মান্নারা একমঞ্চে বসলেন। একটি ঘোষণাপত্রও পাঠ করা হলো। বলা হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি থাকবে কি থাকবে না, সেটি বিএনপির বিষয়। জামায়াত প্রসঙ্গে অস্বস্তি ছিল বদরুদ্দোজাদের। তাঁরা শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় শামিল হলেন না। অথবা বলা যায়, তাঁদের বাদ দেওয়া হলো। শুরু হলো বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য আর জেএসডিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। প্রকৃতপক্ষে এটি হলো আওয়ামী জোটের বাইরে একটি বিস্তৃত প্ল্যাটফর্ম। তাদের ঐকমত্যের ভিত্তি হলো আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে একতরফা নির্বাচন করতে চাচ্ছে, এটা রুখে দাঁড়ানো। তারা বলেছে, তাদের দাবির পক্ষে তারা আন্দোলন করবে এবং এর ভিত্তিতে জনগণের ঐক্য গড়ে তুলবে। বিকল্পধারা এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ায় কিছুটা ছন্দপতন হলো বৈকি। কিন্তু এ নিয়েও আছে কানাঘুষা। নানা অজুহাত তুলে বদরুদ্দোজা চৌধুরীরা কি কালক্ষেপণ করতে চাচ্ছিলেন, নাকি এখানে কোনো আদর্শিক দ্বন্দ্ব কাজ করেছে? এমনও শোনা যাচ্ছে যে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপির কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিলেন না এবং বিএনপির চাপেই তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হলো নতুন এই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেহেতু এর প্রধান প্রতিপক্ষ হলো আওয়ামী লীগ, তাই আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায় ঐক্যফ্রন্টের গুরুত্ব আছে কি নেই। প্রথম প্রথম আওয়ামী লীগের নেতারা এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। পরে তাঁরা অবস্থান পাল্টান। এখন তো তাঁরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। বোঝা যায়, তাঁরা এই ঐক্যফ্রন্টকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছেন, তা না হলে এত গালমন্দ করতেন না।

যাঁরা এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেন, তাঁরা কী পেলেন? ২০–দলীয় জোটকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বিএনপি এককভাবে এদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কতটুকু লাভবান হবে? এ প্রশ্নগুলো এখন মুখে মুখে। এটা একটা সরল অঙ্কের মতোই। ছোট দলগুলো যদি রাজনীতিতে দৃশ্যমান ও প্রাসঙ্গিক থাকতে চায়, তাহলে বড় একটি দলের সমর্থন বা আনুকূল্যের খুবই দরকার। তা না হলে রাজনীতিতে কুলিয়ে ওঠা অসম্ভব। অন্যদিকে নানা কারণে বিএনপি আস্থার সংকটে আছে। আছে ভাবমূর্তির সংকটেও। দলের প্রধান দুই নেতা সামনে আসতে পারছেন না। শিগগিরই তাঁরা এই ঝামেলা কাটিয়ে দলের হাল ধরতে পারবেন বলে মনে হয় না। এ সময় কামাল হোসেনের মতো একজন অভিজ্ঞ ‘অভিভাবক’ পেলে বিএনপি লাভবান হতে পারবে বলে মনে হয়।

ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়া দলগুলোর তেমন জনভিত্তি নেই, কিন্তু তাদের পরিচিতি আছে। ফেস ভ্যালু উপেক্ষা করা যায় না। জোটের রাজনীতির মূল কথাই হলো ছোট হোক বড় হোক, নিজের বলয় যতটা বিস্তৃত করা যায় এবং প্রতিপক্ষকে যতটা কোণঠাসা করা যায়। এ উদ্দেশ্যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ১৪–দলীয় জোট ও মহাজোট। সেখানে অনেক দলের নাম অনেকেই জানেন না। তারপরও জোটবদ্ধ হয়ে তাঁরা বলতে পারেন—আমরা একসঙ্গে আছি।

প্রধানমন্ত্রী বেশ আক্রমণাত্মক ভাষাতেই ঐক্যফ্রন্টের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ঐক্য করেছেন কামাল হোসেন গং। আওয়ামী লীগের নাখোশ হওয়ার কারণ আছে। তাঁরা অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ছিলেন। প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ কেন তাঁদের নিজ বৃত্তের মধ্যে রাখতে পারল না?

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি ও ঘোষণাগুলোর মধ্যে দুই ধরনের কথাবার্তা আছে। প্রথমত, তারা একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে কিছু শর্ত দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবিধানিক সংস্কারের কথা বলছে। এই সংস্কার প্রস্তাবগুলোর গুরুত্ব আছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়কে এ দেশে যে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ও গোষ্ঠীতন্ত্র চেপে বসেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সংবিধানে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগেরও নীতিগতভাবে একমত না হওয়ার কারণ নেই। অর্থাৎ এই দাবি বা প্রস্তাবগুলো নিয়ে একটি বৃহত্তর জাতীয় সমঝোতা হতে পারে। আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে, তারা যেহেতু একটি বড় দল, তাদের বাদ দিয়ে ‘জাতীয় ঐক্য’ হয় কীভাবে? অত্যন্ত যৌক্তিক কথা। নিরঙ্কুশ গণতন্ত্র এবং জবাবদিহির সরকার ব্যবস্থার লক্ষ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে একধরনের জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল। পরে বড় দলগুলো এর প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। এখন আবার একটি সুযোগ এসেছে।

ক্ষমতার রাজনীতিতে নীতিনৈতিকতার বালাই থাকে না। আদর্শের আলখাল্লা গায়ে চড়িয়ে সবাই ক্ষমতা কবজা করতে চান। ফলে একধরনের রাজনৈতিক একচেটিয়াবাদ তৈরি হয়েছে। বিএনপি এখন যত নরম সুরেই কথা বলুক না কেন, তাদের অতীত রেকর্ড তো ভালো নয়। ২০০৭ সালে একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছিল। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচনব্যবস্থাকে ব্যবহার করে এর বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থা চলবে আর কত দিন?

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তৈরি হওয়ার ফলে রাজনীতির মেরুকরণ আরও স্পষ্ট ও তীব্র হলো। এর মধ্যেও আছে নানান টানাপোড়েন। এখানে নতুন কেউ যুক্ত হতে পারেন। এমনকি কেউ কেউ সটকে পড়তেও পারেন। রাজনীতিতে তো সবকিছুই হালাল!

সবার লক্ষ্য এখন আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকে। রাজনৈতিক দলগুলো চায় ক্ষমতা। জনগণ চায় শান্তি ও সমৃদ্ধি। এ দেশের মানুষ নিজের অধিকারের পক্ষে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রতারিতও হয়েছে বারবার। এভাবে আর কত দিন? নাগরিকদের ধৈর্যের তো
সীমা আছে।

১৯৭০ সালের ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আওয়ামী লীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে বলেছিলেন:

বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান

এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দ্রোহের প্রতীক। তাঁর জীবন এবং অভিজ্ঞতা থেকেই এ দেশের মানুষ লড়াই করার প্রেরণা পায়।

মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
[email protected]