সৌদি, গল্পটা কেউ বিশ্বাস করছে না

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি। ছবি: এএফপি
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি। ছবি: এএফপি

সৌদি রাজপরিবারের কট্টর সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগির মৃত্যু সম্পর্কে সৌদি আরবের দেরি করে দেওয়া অসম্পূর্ণ ও গূঢ় উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা খুব কমই বিশ্বাসযোগ্য। সৌদি শাসনব্যবস্থার সমালোচক ও খাসোগির বন্ধু–সমর্থকেরা এই কুৎসিত বানোয়াট ব্যাখ্যাকে নিশ্চিতভাবেই প্রত্যাখ্যান করবে।

গত শনিবার রিয়াদ খাসোগির মৃত্যু সম্পর্কে যে বিবৃতি দিয়েছে, তাকে পশ্চিমা সরকারগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্ভাব্য কূটনৈতিক সংকট কাটানোর একটি চেষ্টা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। রিয়াদ তার বিবৃতিতে বলেছে, মারামারি করতে গিয়ে খাসোগির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে সম্পর্ক রয়েছে, তা ইতিমধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এসব সম্পর্ককে সৌদি আরব তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে।

প্রশ্ন হলো তারা কি মিথ্যা বলবে?

কিছুদিন ধরে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার একটা উপায় খুঁজছেন। কিন্তু সৌদি আরবকে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার জন্য তাঁর দুর্বল প্রচেষ্টা কাজ করছে না। মূলত ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি সৌদি আরব ও খাসোগি হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।

ট্রাম্পের এখন আরেকটি বিশ্বাসযোগ্য গল্পের প্রয়োজন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এই গল্প সরবরাহ করতে পারেন। গত সপ্তাহে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন খাসোগির ব্যাপারে সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য।

ইস্তাম্বুলের কনস্যুলেটে খাসোগির জন্য অপেক্ষারত সৌদি অপহরণকারীদের স্কোয়াডের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৫। একজন মধ্যবয়সী সাংবাদিককে ধরে আনার জন্য কজন মানুষের প্রয়োজন পড়ে? কেন তাঁর হত্যাকারীদের একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন পড়ে?

এটা যদি ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডই না হবে, তাহলে কেন মোহাম্মদ বিন সালমান ও তাঁর কর্মকর্তাদের খাসোগির মৃত্যুর কথা স্বীকার করতে দুই সপ্তাহ সময় লাগল? যদি তাঁরা জানতেনই যে খাসোগি মারা গেছেন, তাহলে তাঁরা কেন বারবার দাবি করেন যে রেকর্ড বলছে, খাসোগি কনস্যুলেটে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে গেছেন।

খাসোগির মৃত্যু যদি মারামারিতেই হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর লাশ কোথায় গেল? কেন তখন কোনো অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়নি এবং পুলিশকে জানানো হয়নি? সৌদি বিবৃতিতে খাসোগির লাশ কোথায় রয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো কিছু বলা হয়নি। তুরস্ক বলছে, খাসোগির লাশ টুকরো টুকরো করে স্যুটকেসে ভরে কনস্যুলেট ভবনের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ইস্তাম্বুলের কাছে একটি বনে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে।

এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে খাসোগি নিহত হওয়ার ঘটনায় বিন সালমান তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই উপদেষ্টাকে বরখাস্ত করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে যুবরাজের অজ্ঞাতসারে এই উপদেষ্টাদের পক্ষে কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব?

বিন সালমান সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি এবং ভয়ংকর স্বৈরাচারী। খাসোগি হত্যাকাণ্ডের অভিযানে যদি কারও কোনো ভুল হতো, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই তা সবার আগে জানতেন।

আগামী দিনগুলোয় খাসোগির শেষ ঘণ্টা সম্পর্কে হয়তো আরও তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু ট্রাম্প ইতিমধ্যে ডুবন্ত সৌদি জাহাজ উদ্ধারের জন্য তাদের দেওয়া বিবৃতিকে ‘সঠিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। সত্যি বলতে কি, যে ব্যক্তি সাংবাদিকদের ‘জনগণের শত্রু’ বলে অভিহিত করেছেন, তিনি কখনো সাংবাদিকতার কল্যাণ বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেবেন না, এটা জানা কথা।

খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর পশ্চিমা গণতন্ত্র রিয়াদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করবে, এমন আশা করা সম্ভবত অবাস্তব। এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন কী করে, তা দেখে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলো সম্ভবত সিদ্ধান্ত নেবে। তবে সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এমনটা হয়তো এ ক্ষেত্রে ঘটবে না। কেননা এ ঘটনার পর পশ্চিমাদের কাছে বিন সালমান আর কোনো সম্মানীয় ব্যক্তি নন।

খাসোগির ঘটনায় সৌদি আরব সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তিত হচ্ছে, যতটা হয়নি ইয়েমেনে হামলার কারণে বা সৌদি নারী অধিকারকর্মীদের জেলে ভরার ঘটনায়।

এ ঘটনা সৌদি আরব ও গোটা আরব বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব থাকার বিষয়টি সামনে এনেছে—যেসব কথা খাসোগি ওয়াশিংটন পোস্ট–এ তাঁর সর্বশেষ নিবন্ধে লিখেছেন।

খাসোগি হত্যাকাণ্ড দেখিয়েছে যে ট্রাম্পের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং তাঁদের ওপর হামলাকারীদের প্রশংসা করেন, তখন কী ঘটতে পারে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রোকেয়া রহমান

সাইমন টিসডাল দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার আন্তর্জাতিক বিষয়ক ভাষ্যকার