শুধু শাস্তিই যথেষ্ট নয়

ফেসবুকে এখন ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ পোস্ট চোখে পড়ছে খুব। মি টু যৌন নিপীড়নবিরোধী অনলাইন প্রচারণা।

গত বছর অক্টোবর মাসে নিউইয়র্ক টাইমস এবং নিউইয়র্কার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে হলিউড সিনেমার প্রভাবশালী প্রযোজক হারভে উইন্সস্টেনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন নারী ধর্ষণের অভিযোগ করেন। এর কয়েক দিন পর হলিউডের অভিনেত্রী আলিসা মেলানো টুইটারে লেখেন, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকলে আপনি মি টু লিখে উত্তর দিন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে #মি টু লিখে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ আলিসাকে টুইট করেন।

‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ দিয়ে লিখেছেন হলিউডের প্রথিতযশা নারী অভিনয়শিল্পীরা। নিপীড়নের অভিযোগে প্রযোজক হারভে উইন্সস্টেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। অস্কার ও কান চলচ্চিত্র উৎসবে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদী কেবল নারীরা নন, কিছু পুরুষও নারীকে যৌন হয়রানি করার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

২০০৬ সালে মি টু শুরু করেছিলেন আমেরিকার সমাজকর্মী তারানা ব্রুক। তিনি পিছিয়ে থাকা ধর্ষণের শিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের সাহায্যে মাইস্পেস নামের সাইটে মি টু প্রচারণা চালু করেন।

বিশ্বময় হলিউডি সিনেমার প্রতাপ। আধিপত্যের দিক থেকে হলিউডের পর আছে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। সম্প্রতি মি টু, ইন্ডিয়া শুরু হয়েছে। শুরুটা করলেন অভিনয়শিল্পী তনুশ্রী দত্ত। বছর দশেক আগে শুটিংয়ের সময় তিনি নিগৃহীত হয়েছিলেন। প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু তখন প্রতিপক্ষের বিষময় প্রতাপে অভিনয় ছাড়তে বাধ্য হন, দেশান্তর হন। সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া মি টু থেকে প্রেরণা পেয়ে আবার কথা বলছেন তিনি।

তনুশ্রীর কথা মুহূর্তে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তনুশ্রী দত্তের পর ফেসবুকে  ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ লিখছেন অন্যরা। পরিচিত দু–একজনও লিখছেন। তাঁদের লেখা আমার নিউজ ফিডে আসছে। মন দিয়ে পড়ছি। নিপীড়নকারীদের মধ্যে চেনা দু–চারজনের নামও দেখছি!

মেয়ে হয়ে জন্ম আমার। বড় হওয়া পুরুষের পৃথিবীতে। বড় হওয়ার কালে আমার শরীরও লোভী পুরুষেরা ছুঁয়ে দিয়েছেন। শরীর কী বুঝে ওঠার আগেই ঘটেছে সেসব। ঘটনা ঘটেছে বাড়িতে, সিঁড়িতে, রাস্তায়, বাসে আর বৈশাখী মেলায়, নিউমার্কেটের ভিড়ে। নিপীড়ক চেনা স্বজন এবং অচেনা মানুষ। ঘটনা ঘটেছে নিরাপদ নির্জনতায়, পথের জনসমাগমে। কৈশোরে শরীর যখন কেবল কথা বলতে শুরু করেছে, তখন পুরুষের হাতে সেই সব ‘না-চাওয়া ছুঁয়ে দেওয়া’ নিতে নিতে বড় হয়েছি।

বড় হলাম, ক্রমে চিন্তা করতে, কথা বলতে শিখলাম। তারপর আমি না চাইলে চেনাদের কেউ আর আমার শরীর ছুঁয়ে দিতে পারেনি। কারণ, তত দিনে আমি সাবধান হয়েছি। ব্যক্তিত্বের ধরনও এমন হয়ে উঠেছে যে পাশে থাকা পুরুষেরা আমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার দুঃসাহস করেন না।

‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ লিখতে শুরু করেছেন সিনেমার মেয়েরা।

এক শতকের বেশি সময় ধরে সিনেমা বিশ্বময় দোর্দণ্ড প্রতাপে ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে। সিনেমা বা আরেকটু বিস্তৃত করে বলি দৃশ্যমাধ্যম মানুষের দেখার চোখ এবং অনুধাবনের স্তরগুলোকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। এই প্রভাবের চক্করে আমরা নিজের অজান্তে ঢুকে যাই। সিনেমা বানাতে অনেক টাকা লাগে। সমাজে টাকার মালিক মূলত পুরুষেরা। লগ্নি করা অর্থ ফেরত আনতে সিনেমার মূল নির্ভর সন্ত্রাস এবং যৌনতায়। এই যৌনতা মূলত পুরুষের যৌনতা। পর্দায় উপস্থাপিত নারীর শরীর সিনেমার অন্যতম উপাদান। নারী এখানে যৌন উপকরণ, পুরুষের ভোগের বস্তুমাত্র।

নারীকে পুরুষের যৌন বস্তু মনে করা কি কেবল সিনেমার বিষয়? অবশ্যই না। হাজার হাজার বছর পথ হেঁটে মানুষের সভ্যতা হয়ে উঠেছে আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক। এই সভ্যতায় নারী অধস্তন, পুরুষের কামনার বস্তু। সিনেমা এই সমাজ, সভ্যতার আয়না। সিনেমার পর্দায় নারী তাই পুরুষের ভোগ্য বস্তু।

যৌনতা মানুষের অন্যতম শক্তিশালী রিপু। যৌনসম্পর্ক থেকে এই পৃথিবীতে মানুষ নামে জীবের প্রবাহ বয়ে চলেছে। তবে সমাজে নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক কেবল যৌনতায় আবদ্ধ নয়। তার আরও নানান রূপ ও রং আছে। সিনেমা নারী-পুরুষ সম্পর্কের সেই সব রূপ ও রংকে উপেক্ষা করে হয়ে উঠেছে পুরুষের যৌন ইচ্ছাপূরণের একটি হাতিয়ার।

মাধ্যম হিসেবে প্রকাশের সময় সিনেমা বাস্তবের হুবহু প্রতিরূপ ছিল। কিন্তু ক্রমে সিনেমার পর্দায় পুনর্নির্মিত বাস্তবতার প্রতিরূপ আমরা বানাতে শিখেছি। এই পুনর্নির্মিত বাস্তবতার প্রতিরূপ নির্মাণকারীদের বানানো সিনেমাই বেশি দর্শকের কাছে যায়। এরাই বাণিজ্য করে, লাভের মুনাফা গড়ে। যৌনবস্তু হিসেবে নারীর উপস্থাপন, পুরুষের পেশি এবং অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখিয়ে লগ্নি করা টাকা দর্শকের কাছ থেকে ফেরত আনে। এটা একটা চক্র। সোয়া শ বছর আগে থেকে যাত্রা করে সিনেমা এখন এই চক্রের মধ্যে খাবি খাচ্ছে।

নারীরা এখন হ্যাশট্যাগ মি টুর কথা বলতে শুরু করেছেন। তবে কেউ এখনো সিনেমায় নারীকে পুরুষের যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপনের বিরুদ্ধে কথা বলেননি! বলাটা হবে জলে বসে ডাঙার কুমিরের সঙ্গে লড়াই। সে এক কঠিন লড়াই।

‘হ্যাশট্যাগ মি টু ইন্ডিয়া’ নামে বহু পোস্ট এখন ফেসবুকে পড়ছি। বন্ধুদের লেখায় অনেক রাঘববোয়ালকে যৌন নিপীড়ক রূপে জানছি। আশার কথা, এই যে ভারতে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ সব পেশায় নারীর যৌন হয়রানিমুক্ত কর্মজীবনের দাবিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। মাত্র কয়েক দিনে ১০-১২ জন নারী সাংবাদিক  হ্যাশট্যাগ মি টুতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ আদালতে প্রমাণের আগেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো। মি টুর জোয়ারে বলিউডেও তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।

মি টু এখন আর সিনেমার নারীদের মধ্যে সীমিত নেই। এর আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। পুরুষেরাও নিগ্রহের কথা লিখছেন। হেনস্তাকারীকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, বয়কট করা হচ্ছে এবং শাস্তির কথাও ভাবা হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে বিরাট কিছু। তবে শুধু শাস্তিই যৌন নিপীড়নমুক্ত করবে না আমাদের।

মানবসভ্যতাকে পুরোপুরি যৌন নিপীড়কমুক্ত হতে হলে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হবে। আমাদের সন্তানেরা যেন যৌন নিপীড়নকারী হিসেবে বড় না হয়, তার জন্য পৃথিবীর সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। সেই কাজে সিনেমাই হতে পারে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। কারণ, সিনেমাই এখনো একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। তবে তাকে হতে হবে ‘নতুন সিনেমা’।

ডিজিটাল এই সময়ে নতুন সিনেমা বিগ বাজেট, বিগ সিনেমা হলেও বিগ মার্কেটিং উপেক্ষা করতে পারে। হাতের মুঠোয় থাকা ছোট্ট ফোনটিকে আমরা সিনেমা নির্মাণ ও প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার করে তুলতে পারি। সেটা পারলে বিগ বাজেটের জন্য বড় আপসকামিতাকেও আমরা বিদায় বলতে পারব।

জয়তু, হ্যাশট্যাগ মি টু।

ফৌজিয়া খান স্বাধীন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা