সফল নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজন

নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হচ্ছে। বিএনপি নানা কারণে কোণঠাসা অবস্থায় আছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরেসোরে চালিয়ে যাচ্ছে, শুধু তাদের পোস্টার–ব্যানারেই ছেয়ে গেছে সারা দেশ। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন প্রার্থী, সম্ভাব্য প্রার্থী ও সমর্থকেরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করছেন। যেহেতু নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেনি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সরকারি সফরের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণাও চালাচ্ছেন। এ ধরনের প্রচারণা নির্বাচনী আইন বা আচরণবিধির মধ্যে না থাকায় নির্বাচনী আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে না। বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত প্রধান বিরোধী দল এ ধরনের প্রচারণায় নামতে না পারায় নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ অবস্থায়ও দেশবাসীর আশা, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হোক।

তবে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের আলোচনায় এবং পত্রপত্রিকায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের লেখায় নানা ধরনের প্রশ্ন উচ্চারিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বা সংশয় হলো নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে। এ বিষয়ে অনেকেই নির্বাচন কমিশনের দিকে তর্জনী উঠিয়ে থাকেন, কিন্তু তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত নয়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই। এর সুযোগ নিয়েই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাক্-নির্বাচনী সময়ে পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব সরকারের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বটে। তবে সরকারের দায়িত্বই বেশি। উল্লেখ্য, সরকার নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী শরিক। কাজেই নির্বাচনী পরিবেশ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের যেকোনো উদ্বেগ নিয়ে কমিশন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।

সাধারণত মনে করা হয়, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা শুধু নির্বাচন কমিশনের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু তা মোটেই নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নির্বাচনী শাসনব্যবস্থার (Electoral Governance) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলেও নির্বাচনী শাসনব্যবস্থা আরও বিস্তৃত। এ বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন হলেও উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এটা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। নির্বাচনী শাসনব্যবস্থার সরল সংজ্ঞা হলো, ‘গণতান্ত্রিক দেশে এই সময়সীমা একটি নির্বাচন হতে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত, এর মধ্যে মধ্যবর্তী নির্বাচনও অন্তর্ভুক্ত। নির্বাচনী শাসনব্যবস্থায় সাধারণত তিনটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জড়িত, সংসদ প্রয়োজনীয় আইন পরিবর্তন ও সংশোধন করে এবং এর সময়কালের পরিধি সাধারণত নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে। তবে বিচার ব্যবস্থাপনা নির্বাচনী শাসনব্যবস্থার পরিধির মধ্যেও সক্রিয় থাকে।’

সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে নির্বাচনের সঙ্গে শরিক সবাইকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সঠিক কাজটি করতে হয়। ওপরে উল্লিখিত তিনটি প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ক্ষেত্রের কাজগুলো সঠিক সময়ে সম্পন্ন না করলে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিঘ্নিত হয়ে থাকে। যেহেতু নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাই এক নির্বাচন থেকে পরবর্তী নির্বাচনের পূর্ণ সময় নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হয়। এ সময়টি তিন ভাগে বিভক্ত। যথা: প্রাক্-নির্বাচনী সময়, নির্বাচনকালীন সময় এবং নির্বাচন–পরবর্তী সময়। প্রাক্–নির্বাচনী সময়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার শরিকেরা, বিশেষ করে সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বও রয়েছে পরবর্তী নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা এবং সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করার। অন্যথায় নির্বাচন ব্যর্থ অথবা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়ে আসছে। ব্যর্থ বা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়, তা রাজনৈতিক শাস্ত্রমতে, সংকরজাতীয় বা দো–আঁশলা (Hybrid) গণতান্ত্রিক সরকার বলে পরিচিত। দো–আঁশলা সরকার ক্রমেই স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নেয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেনেডি স্কুলের তুলনামূলক রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক ড. পিপ্পা নরিসের মতে, এ ধরনের সরকার একদিকে শুদ্ধ স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা যেমন ব্যবহার করতে পারে না (সর্বক্ষেত্রে), তেমনি একটি পরিপক্ব গণতান্ত্রিক সরকারও হয়ে উঠতে পারে না। কাজেই এ ধরনের সরকার চেষ্টা করে বিভিন্ন উপায়ে পরবর্তী নির্বাচনকে নিজের অনুকূলে আনার। ফলে তারা আবার ব্যর্থ নির্বাচনের পথে হাঁটে, এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সরকার ও রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিশ্বের বিভিন্ন সময়ের বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায় যে ব্যর্থ নির্বাচনের আলামতগুলো তিন পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়। এসব আলামত প্রাক্–নির্বাচনী সময় থেকেই দৃশ্যমান হতে থাকে। ড. পিপ্পা নরিস ও অন্যরা তাঁদের গবেষণালব্ধ বই হোয়াই ইলেকশনস ফেইল–এ বলেছেন, নানা কারণে নির্বাচন ‘ব্যর্থ’ অথবা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হয়। এসব উপাদান তৈরি করা হয়, যাতে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটানো যায়, অথবা তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা যায়। এসব প্রয়াসের মধ্যে থাকে: প্রতিপক্ষের শক্ত প্রার্থী হতে পারে, এমন ব্যক্তিদের বিভিন্ন উপায়ে নির্বাচনের অযোগ্য করা; সীমানা পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে সংসদীয় আসন নিজের অনুকূলে আনা; সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা, তাকে নিজের অনুকূলে আনা; ভোটার তালিকা হালনাগাদ বা সংশোধন না করা ইত্যাদি। এগুলোর বেশির ভাগ প্রাক্–নির্বাচন সময়ে ঘটে থাকে।

আরও যেসব উপায় অবলম্বন করা হয় সেগুলোর মধ্যে আছে: ১. ভোটের আগে ভোটারদের ভয় দেখানো; ২. প্রচারণাকে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে রাখতে প্রশাসনের অপব্যবহার; ৩. ভোটারদের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ বিতরণ; ৪. প্রতিপক্ষকে মিডিয়ায় সমান সুযোগ না দেওয়া; ৫. নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত কর্তাদের দলীয় আনুগত্যের কারণে সবার সঙ্গে সমান আচরণ না করা এবং ৬. এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা, যাতে প্রতিপক্ষ নির্বাচন বর্জন করে। এগুলো নির্বাচনী সময়ের মধ্যে প্রচারণার কালেই ঘটানো হয়ে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অন্যান্য উপাদান, যেমন নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দলীয় আনুগত্য।

ভোট গ্রহণ ও ভোট গণনার সময় যেসব বেআইনি কাজ হয়, সেগুলোর কারণেও নির্বাচন ‘ব্যর্থ’ অথবা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হয়ে থাকে। যেমন: ১. ভোটারদের ভয়ভীতির মাধ্যমে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করা; ২. বুথ দখল এবং ব্যালট পেপার ছিনতাই; ৩. ধীরগতিতে ভোট গ্রহণ; ৪. অপর্যাপ্ত ব্যালট পেপার সরবরাহ; ৫. অর্থ বিতরণ; ৬. একের অধিক ভোট প্রদান এবং ৭. পোলিং স্টেশনগুলো সুবিধাজনক জায়গায় স্থাপিত না হওয়া। অভিজ্ঞতার আলোকে আরও যোগ করা যায়: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতা ও পক্ষপাত; নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় শিথিলতা; ভোট গণনায় কারচুপি। এ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার পূর্ণ সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তবে এ পর্যায়ে সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ত্রুটিপূর্ণ হলে নির্বাচন যেমন ত্রুটিপূর্ণ হয়, তেমনি এর ফলাফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৃহীত হয় না।

নির্বাচনী শাসনব্যবস্থায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগ। নির্বাচনবিষয়ক বিরোধগুলোর বিচার ন্যূনতম সময়ে নিষ্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। নইলে নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হয়, ব্যাপকভাবে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন থেকে দেশে অরাজকতা দেখা দিতে পারে। বিচারব্যবস্থার সহযোগিতা না পেলে নির্বাচন কমিশন দুর্বল থাকে। বিচারব্যবস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হয়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় শক্তি বিচার বিভাগ, বিশেষ করে উচ্চ আদালতগুলো।

নির্বাচন ‘ব্যর্থ’ বা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ হওয়ার উল্লিখিত উপাদানগুলোর আলোকেই দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচনের মূল্যায়ন করে থাকেন। আমাদের ক্ষেত্রেও সেটাই বিবেচ্য। আমরা আশা করি, সব রাজনৈতিক পক্ষ, সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার শরিকদের পূর্ণ সহযোগিতায় আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক
hhintlbd@yahoo. com