নাম ও প্যাডসর্বস্ব দলের মর্মকথা

যত গুড় তত মিঠা। তাতে কারও সন্দেহ নেই। কিন্তু যে দেশে যত বেশি রাজনৈতিক দল সে দেশে তত বেশি গণতন্ত্র—তা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। বরং উল্টোটাও হতে পারে। দল যদি দুচার পাঁচটি থাকে, তাহলে কে কার সঙ্গে জোট বাঁধবে? জোট বাঁধার প্রয়োজন হয় তখনই, যখন দলের সংখ্যা প্রচুর। সে কারণে বাংলাদেশে শুধু যে দলের সংখ্যা বেশি তা-ই নয়, জোটের সংখ্যাও বহু। আমাদের দেশে জোট যত, অধিকাংশ প্রধান গণতান্ত্রিক দেশে অত দলও নেই। বর্তমানে জোটের সংখ্যা ১৪। আগামী নির্বাচনে এগুলোর মধ্যে যদি এক জোট ক্ষমতায় যায় আর এক জোট বিরোধী দলে থাকে, অন্য ১২টি জোটের নেতাদের হাহাকার করা ছাড়া আর কোনো কাজই থাকবে না।

দল গঠন ফান্ডামেন্টাল রাইট, আমি তার সদ্ব্যবহার করব না কেন? আমার ধর্মপত্নী এবং আমি মিলে বাংলাদেশ জাতীয় কলামিস্ট পার্টি (বিজেকেপি) গঠন করলাম। আমি চেয়ারম্যান, গিন্নি মহাসচিব, আমার বেয়াই কোষাধ্যক্ষ এবং পুত্র সাংগঠনিক সম্পাদক। প্যাডের কাগজে পাঠালাম পত্রিকায় বিবৃতি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকার ব্যর্থ, তাই সরকারের পদত্যাগ চাই। বিজেকেপির বিবৃতি কাগজে ছাপা হলো, কিন্তু কেউই জানতে চাইলেন না যে এই দলটি কবে গঠিত হয়েছে এবং এর নির্বাহী কমিটিতে আরও পাঁচ-দশজন আছেন কি না।

বাংলাদেশের ১৯৩টি নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত দলের মধ্যে ১৮০ টির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কখনো জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়া তো দূরের কথা, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন কি না, কোনো এনজিওর কনসালট্যান্টদের দিয়ে গবেষণা না করিয়ে বলা সম্ভব নয়। ১৫০টি দলের সভাপতিকে তাঁর ইউনিয়নের মানুষ চেনে কি না, তা তাঁরা ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। কী সেই কর্তব্যবোধ, যা দ্বারা প্রণোদিত হয়ে তাঁরা রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হলেন। ১৮০ জন দলীয় প্রধান যদি তাঁদের গ্রামে একটি করে ক্লাব ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতেন এবং তা থেকে যদি ১০০ জন মানুষও উপকৃত হতো, তা হলে দেশের ১৮ হাজার মানুষের দ্বারা জাতি লাভবান হতো।

বাংলাদেশে এই যে প্রায় ২০০ দল (প্রকাশ্য ও আন্ডারগ্রাউন্ড মাওবাদী দল যোগ দিলে ৩০০ ছাড়াবে), এগুলো নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যদি গবেষণা-সন্দর্ভ রচনা করতে যান, তাঁদের মাথা ঠিক থাকবে না। এইসব দলের নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য নিয়ে গবেষণার আগে মনোবিজ্ঞানীদের দিয়ে নেতাদের মনস্তত্ত্ব সমীক্ষা করা প্রয়োজন। সংসারে আরও বহু কাজ থাকতে কেন তাঁরা রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। এবং নির্বাচনের আগে কেন এত দলের নেতায় রাজনৈতিক অঙ্গন কিলবিল করতে থাকল। বড় বড় দল কেন তাদের আলিঙ্গন করার জন্য এত ব্যাকুল। যে তিনটি বড় দল স্বাধীনতার পর থেকে দেশ শাসন করেছে এবং করছে, তারা কেন নামসর্বস্ব ও প্যাডসর্বস্ব ‘দল’কে তাদের দিকে টানছে। এ প্রশ্নের জবাব একটাই—তাদের দেউলিয়াত্ব। মূল্যহীনকে স্বীকৃতি দেওয়া দুর্বলতার লক্ষণ।

আওয়ামী লীগের ১৪-দলীয় জোটের ৮টিই অনিবন্ধিত। বিএনপির ২০-দলীয় জোটের ৯টি অনিবন্ধিত। পল্লিবন্ধুর সম্মিলিত জাতীয় জোটের ৫৮টি দলের মধ্যে নিবন্ধিত মাত্র ২টি। বিএনপি ফেলে আসা ব্যারিস্টার সাহেবের জোটের নাম বিএনএ, তার ৩৪ টির একটিও নিবন্ধিত নয়। তাঁরা বলবেন ব্যারিস্টার এম কে গান্ধীর কংগ্রেস এবং ব্যারিস্টার এম এ জিন্নাহর লিগও নিবন্ধিত ছিল না। সুতরাং নিবন্ধন কোনো ব্যাপার নয়, উপমহাদেশের ১৩৩ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে অনিবন্ধনের গুরুত্বই বেশি। অনিবন্ধিত তিনটি রাজনৈতিক দল ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনতে পারলে, এখন অনিবন্ধিতরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না কেন?

নির্বাচনের আগে জোট গঠনের তোড়জোড় সম্পর্কে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘কিছু জোট অহেতুক হয়েছে। কোনোরকমে ক্ষমতার অংশীদার হতেই এই তৎপরতা।’ বিএনপির নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জোট-মহাজোটের ধারণাকে তাঁরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখেন। কারণ, এর মাধ্যমে বহুমতের উপস্থিতি থাকে।

[প্রথম আলো, ১৭ অক্টোবর] বর্তমানে ‘১৪টি জোটে থাকা দলগুলোর বেশির ভাগই নাম বা প্যাডসর্বস্ব। তাই অনেক সময় শরিক দলের সংখ্যা কত, কোনটার নেতা কে; তা জোটের নেতারাই বলতে পারেন না।’

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে প্যাডসর্বস্ব দলের নেতারা বড় দলের অফিসের দিকে বনপোড়া হরিণের মতো ছুটছেন। আগে কখনো তাঁদের নামগন্ধ শোনা যায়নি। রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বা সুন্দরবনের নিয়তি নিয়ে তাঁরা একটি কথা বলেননি। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন নিয়ে তাঁদের কোনো উদ্বেগ নেই। জ্বালানি খাতের দুর্নীতি নিয়ে তাঁদের উচ্চবাচ্য শোনেনি কেউ। কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও তাঁরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। তাঁদের তৎপরতা নির্বাচনের আগে। বড় দলের কাছে আসনের আবদার করেন। সংসদের একটি আসন যেন ছেলের হাতের মোয়া! সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতার কাজটা কী? পৌনে ২০০ দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে যদি লোকজন গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি কে? আপনার ‘দল’ ও আপনার কাজটা কী? তাঁরা কী জবাব দেবেন?

তবে তাঁদের সৎসাহস থাকলে বলবেন, কোনো কাজকাম নাই ভাই। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার আশা করি না। সরকারি দলের নেতাদের তোয়াজ করে বালবাচ্চা নিয়ে সুখে থাকব। রাজউক থেকে তিন কাঠা জমিও বাগিয়ে নিতে পারি। সরকারি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বা অন্য কোনো সম্মেলনে যাওয়ার সুযোগ হবে। ভুয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে ফেরত-অযোগ্য ব্যাংকঋণ পেতেই ‘দল’ গঠন করি এবং সরকারি জোটে যোগ দিই।

অনেক কিছু নিয়েই ব্যঙ্গ করা যায়। দেশ, জাতি ও জনগণের সঙ্গে তামাশা চলে না। রাজনীতি কোনো ছেলেখেলা নয়। যাঁরা কখনো ত্যাগ স্বীকার করেননি, জনগণের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকেননি, তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার থাকলেও রাজনৈতিক ‘দল’ গঠনের নৈতিক অধিকার থাকতে পারে না। রাজনীতির নামে জনগণের সঙ্গে ফাজলামি করা ঘোরতর অন্যায়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক