'আউট' বই কি পড়ালেখায় ক্ষতি করে?

আমাদের দেশে গল্পের বইয়ের আরেকটা নাম আছে আউট বই বা বাইরের বই। মানে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যেকোনো বইকে আমাদের অভিভাবকেরা বাইরের বই বলে ভাবতে এবং বলতে অভ্যস্ত; অর্থাৎ এটা পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে পড়ে না। এটা বাইরের বিষয় এবং তাঁদের মানসিকতাটাই এমন যে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে গেলে গল্পের বই পড়ার মতো মনোযোগ নষ্টকারী বিষয় অবশ্য পরিত্যাজ্য। সারা জীবনে মার কাছে যত পিটুনি–বকুনি খেয়েছি, তার শতকরা ৯০ ভাগ খেয়েছি গল্পের বই পড়ার জন্য। বর্তমানেও এর যে খুব বেশি ব্যতিক্রম হয়, এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। ২০১৬ সালে আমাদের অফিসে শিশু দিবস উপলক্ষে অনেক বাচ্চাকাচ্চা এসেছে, তো তাদের মধ্যে কিশোর দলটাকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম কার কার বাবা–মা গল্পের বই পড়লে বকা দেন? দুঃখজনক হলেও সত্যি প্রায় ১০–১২ জনের একটা দল, সবাই হাত তুলল। এটা আমার জন্য চমক ছিল। কারণ আজ থেকে ২০–২২ বছর আগে আমি ওই বয়সী ছিলাম, আমার মা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, চাকরি করতেন না, কাজেই গল্পের বই বিষয়ে তাঁর আপত্তি থাকতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বাচ্চাকাচ্চাগুলোর বাবা–মা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় বড় বড় চাকরি করেন, ইতিমধ্যে ২০ বছর সময় পার হয়ে গেছে, অথচ অভিভাবক হিসেবে মা–বাবা সেই একই জায়গায় পড়ে আছেন। গল্পের বই মানে বাইরের জিনিস, এটা বেখেয়াল করে, এর মধ্যে ছেলেপুলেকে জড়িত হতে দেওয়া যাবে না। এখন আপনার মতো আমিও কতগুলো প্রশ্ন করি, গল্পের বই কি আসলে বাচ্চাকাচ্চার জন্য ভালো না মন্দ? আসলে গল্পের বই কী? এটা মানুষের মনস্তত্ত্বে কি কোনো প্রভাব রাখে? মানুষের বুদ্ধি বিকাশের সঙ্গে গল্পের বইয়ের কোনো সম্পর্ক আছে? না গল্পের বই আসলেই ঠাসবুনোটে কিছু মিথ্যা কথা?

আমার চাকরিজীবনে অসম্ভব মজার একটা প্রকল্পে কাজ করেছি। প্রকল্পটার আওতায় প্রত্যন্ত গ্রামে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পাঁচ শ করে গল্পের বই দেওয়া হতো। তো, সেই সংস্থায় যখন যোগদান করলাম, কান্ট্রি ডিরেক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম এত কিছু থাকতে গল্পের বই দিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? ভদ্রলোক খানিক চুপ থেকে বললেন, ‘আপনি কি মনে করেন সবার থেকে আপনি অনেকখানি আলাদা?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, মনে করি।’ ভদ্রলোক তারপর বললেন, ‘আপনি আপনার জীবনের এমন একটা বিষয় বলেন, যেটা আপনার এই অন্য রকম হওয়ার পেছনে প্রভাব ফেলেছে?’ এবার চুপ থাকার পালা আমার। অনেক ভেবে, অবাক হয়ে আমি উত্তর দিতে বাধ্য হলাম, বাইরের বই মানে আমার মা–বাবার কাছে যেটা ছিল আউট বই। কেউ যদি আমার অন্য রকম হওয়ার পেছনে দায়ী থাকে, সে হচ্ছে কম বয়সে পড়া আমার গল্পের বইগুলো।

আগের প্রশ্নে আবার ফিরে যাই। বই আসলে কী করে? মজার বিষয় হচ্ছে একেক বয়সে বই একেক রকম ভূমিকা রাখে। ধরুন মানুষ যখন মাত্র পড়তে শেখে, তখন গল্পের বই সেই পড়তে শেখার ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। গল্পের বই যে কোনো ভাষার লিখিত রূপ পড়তে শেখাকে ত্বরান্বিত করে। আবার মানুষ যখন লিখিত রূপ পড়তে শিখে গেল, তখন এই বই পড়েই সে আবার বিভিন্ন বিষয় শিখতে শুরু করে। মানে সে ক্রমাগত পড়ার মধ্যে দিয়ে শিখতে থাকে। এই পড়ার ব্যাপ্তি যত বেশি হয়, তার শেখার পরিধিও তত বড় হয়। আমরা সাংস্কৃতিকভাবেই ধরে নিই শিখতে হলে শিক্ষণীয় বই লাগবে। মানে সাধারণ যে গল্পের বই সে সব বইয়ে শেখার কী আছে? শিক্ষণীয় বই মানেই তথ্যবহুল বই। আসলেই কি তাই? অল্প বয়সে গল্পের বই মস্তিষ্ক গঠনে সরাসরি ভূমিকা রাখে। মস্তিষ্কের কোষ শারীরিকভাবেই গঠিত হয়ে যায় কিন্তু মস্তিষ্কের কোন কোষ কতখানি সক্রিয় হবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কে আপনি কী ধরনের উদ্দীপনা দিচ্ছেন তার ওপর। গল্পের বই হচ্ছে অতি উচ্চমানের উদ্দীপক। অল্প বয়সে যে শিশুটা অনেক কাল্পনিক বই পড়বে, স্বাভাবিকভাবেই তার মস্তিষ্কের যে অংশ কল্পনাপ্রবণ হওয়ার জন্য কাজ করে, সেই অংশটা উদ্দীপ্ত বা জাগ্রত হবে। যে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ও যুক্তিমূলক বই পড়বে, মজার মজার অঙ্কর বই পড়বে, সে তার মস্তিষ্কের যে জায়গাটা যুক্তি করে, সেই জায়গাটা সক্রিয় হওয়ার জন্য রসদ জোগাবে। পাঠ্যবইয়েও যুক্তি, কল্পনা, জ্ঞান এসব আছে। কিন্তু তা আছে সেটুকু, যতটা জানলে একজন নিজে নিজে ওই সব বিষয়ের বাইরের বই খুঁজে নিয়ে পড়তে পারে। পাঠ্যবই হলো, আরও বেশি জানা ও পড়ার একটা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। তো, আপনি প্রশিক্ষণ নিলেন কিন্তু কাজে নামলেন না, সেটা কেমন হলো? এ জন্যই আমাদের অনেক পড়া কাজে আসে না। কারণ আমরা জীবনে কাজে লাগানোর মতো যথেষ্ট বই পড়ি না।

ধরুন একজন মানুষ পাঠ্যবইয়ের বাইরে সারা জীবনে আর কোনো বই পড়েনি, তার চিন্তা আসলে কেমন হবে? এ রকম মানুষ আমাদের আশপাশে কম নেই, তাদের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন, একজন অনেক বই পড়া মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা আর একজন বই না পড়া মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতায় কী সাংঘাতিক পার্থক্য। বই মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতাকে প্রসারিত করে জানা ও শেখার উপায় অনেক ছিল। গুরু ধরে, প্রকৃতির মধ্য থেকে, পূর্বপুরুষ ও নারীদের সাহচর্য থেকে, জ্ঞানী ও শিল্পীদের সাহচর্য থেকে শিখত মানুষ। বই হাতের কাছে সেই সুযোগগুলোই এনে দেয়। তাই বই একটা হচ্ছে মস্তিষ্কের চিন্তা করার ক্ষমতাকে বাড়ায় আবার ভাবনা তৈরি করার ক্ষেত্রেও সাংঘাতিকভাবে ভূমিকা রাখে।

বাবা–মা হিসেবে এই গল্পের বই পড়েই খুব অল্প বয়স থেকেই শিশুর বুদ্ধি বিকাশে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারেন। সেটা কীভাবে? আপনি দেড় বছর বয়সেই বাচ্চাকে বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। রঙিন ছবির বড় বড় বই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পড়ে শোনাতে পারেন। তাকে রং চেনালেন, মানুষের ছবি দেখালেন, পশু, পাখি চেনালেন। কণ্ঠ ওঠানামা করে গল্প শোনালেন। একটু বড় হলে গল্পের চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করলেন। কাকে ভালো লাগল? কেন ভালো লাগল? গল্পের নামটা এ রকম না হয়ে কী হতে পারত? আর অন্য কী রকম হলে তোমার গল্পটা ভালো লাগত? এই প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে আপনি আসলে আপনার শিশুকে চিন্তা করতে শেখাচ্ছেন। যা পড়ল তার বাইরেও কীভাবে ভাবতে হয়, কী রকম করে ভাবা যায় তার প্রক্রিয়াটাও শেখাচ্ছেন। আপনি যদি প্রশ্ন করার মধ্যে শিশুকে একবার অভ্যস্ত করে ফেলতে পারেন, বাকি কাজটা সে নিজেই সেরে নেবে। তাকে প্রশ্ন করা বা প্রশ্ন করতে শেখানো মানে তাকে আপনি চিন্তার খোরাক দিচ্ছেন। চিন্তার খোরাক মানে সরাসরি উদ্দীপনা। আপনি শুধু যদি বই পড়ার অভ্যাসটা ধরিয়ে দিতে পারেন, ওর নিজের পছন্দের বই সে নিজেই খুঁজে নেবে। বই মানুষকে কল্পনা করতে শেখায়, যুক্তি করতে শেখায়, আবেগী হতে শেখায়—মোটের ওপর চিন্তা করতে শেখায়, বিবেক–বুদ্ধি বাড়ায়।

দিলশানা পারুল: শিক্ষা গবেষক এবং বাস্তবায়নকর্মী।