সৌদি যুবরাজকে কেন বাঁচাতে চান ট্রাম্প

সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প । ছবি: রয়টার্স
সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প । ছবি: রয়টার্স

ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, বিশ্বে এখন ‘ভুয়া খবর’ ও ‘ভুয়া ঘটনার’ যুগ চলছে। সেই হিসেবে ‘ভুয়া তদন্ত’ তো হতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ব্রেট কাভানার বিরুদ্ধে ওঠা ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত যেভাবে হয়েছে, ঠিক একই কায়দায় জামাল খাসোগি হত্যায় সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের জড়িত থাকার অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। যিনি অভিযুক্ত, তিনিই তদন্তকারী—এর চেয়ে অসম্ভব কোনো কথা এর আগে কেউ কোনো দিন শুনেছে? হ্যাঁ, ট্রাম্প আমাদের এমন একটি সময় উপহার দিয়েছেন, যখন এমন অসম্ভবও সম্ভব হচ্ছে। সৌদি শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে, খাসোগিকে তাদের কনস্যুলেটের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছে এবং এ ঘটনায় জড়িত ১৮ জনকে তারা গ্রেপ্তার করেছে।

খাসোগি হত্যা নিয়ে মুখ খোলার আগে সৌদির হলিউডের কোনো একজন ‘স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজারকে’ ভাড়া করা উচিত ছিল। তা না করে তারা প্রথমেই খাসোগি হত্যা অস্বীকার করল। আর এখন তারা খাসোগিকে ব্রুস লির মতো দাঁড় করিয়ে মার্শাল আর্টভিত্তিক অ্যাকশন ছবির শুটিং শুরু করেছে। সৌদি ভালো করে জানে, বিশ্ব আহাম্মক নয়, কিন্তু পাশাপাশি তারা এ–ও জানে, ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার তাদের পকেটে আছে।

গত দুই বছরে বিশ্ববাসী জেনে গেছে, ট্রাম্প যেভাবে তাঁর রিয়েল এস্টেট ব্যবসা চালাতেন, ঠিক একইভাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় চালান। সভ্যতা–ভব্যতার ধার না ধেরে ট্রাম্প যেভাবে একজন ধর্ষককে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং তাঁর দোষ ঢেকেছেন, একইভাবে তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের পক্ষে কথা বলছেন। সৌদি এই যুবরাজ নিজেই তাঁর নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করছেন এবং তিনি যা যা বলছেন, তাতে নির্বিকারভাবে সায় দিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প।

খাসোগি হত্যায় সৌদি যুবরাজের হাত থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে ট্রাম্প এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘নিরপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে অপরাধী ভাবতে হবে—এই নীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। প্রধান বিচারপতি কাভানার বিষয়ে অভিযোগ ওঠার পরও আমি এই একই কথা বলেছি এবং যত দূর জানি, কাভানা নিরপরাধ।’ তবে আমরা ভালোভাবেই জানি, ট্রাম্প যা ‘জানেন’, তা সত্য থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। এই কারণে বোঝা যাচ্ছে, কাভানার অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার মতোই খাসোগি হত্যার সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।

হোয়াইট হাউসের সৌদির পাশে দাঁড়ানোটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু নিজের ইহুদি জামাতাকে নিয়ে ট্রাম্প সৌদি ইস্যুতে যা করছেন, তা এত দিনকার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট (এই পত্রিকায় খাসোগি কলাম লিখতেন) তাদের সম্পাদকীয়তে বলেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও রিয়াদে গিয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে যেভাবে হাস্যোজ্জ্বলভাবে আলাপ করেছেন, তা দেখে বোঝা যায়, তিনি আসলে এই হত্যার তদন্তকাজ জোরদার করার জন্য নয়; বরং মোহাম্মদ বিন সালমানের দুষ্কর্ম ঢাকার জন্যই সেখানে গিয়েছিলেন।

নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার খবর অনুযায়ী, জ্যারেড কুশনারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই সৌদি যুবরাজ। কুশনার তাঁকে সার্বিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। পত্রিকাটি বলেছে, কুশনার তাঁর শ্বশুর ট্রাম্পকে মোহাম্মদ বিন সালমানের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করেছেন। ট্রাম্পের এক ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, জ্যারেড ট্রাম্পকে বুঝিয়েছেন, আগের অন্য সমালোচনার মতো এই সমালোচনার প্রবাহ থেকেও সৌদি যুবরাজ বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন।

এখন ট্রাম্প কেন সৌদিকে এত সহায়তা করছেন? মোটামুটি সবাই জানে, সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন ট্রাম্প। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য আরও ফুলে–ফেঁপে উঠবে। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, তাঁর সাহায্য ছাড়া সৌদি সরকার দুই সপ্তাহও টিকবে না। সৌদি যদি এত দুর্বল রাষ্ট্রই হয়ে থাকে, তাহলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে রক্ষায় হোয়াইট হাউসের কী স্বার্থ থাকতে পারে?

তবে তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ট্রাম্প আর মোহাম্মদ বিন সালমানের জারিজুরি খুব সতর্কতার সঙ্গে ফাঁস করে দিচ্ছেন। চামচে করে দুধ খাওয়ানোর মতো মিডিয়াকে তিনি একটু একটু করে খাসোগি হত্যার তথ্য সরবরাহ করছেন।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, খাসোগি হত্যাসংক্রান্ত সব সত্য বেরিয়ে আসুক, এমন উদ্দেশ্য না আছে ট্রাম্পের, না মোহাম্মদ বিন সালমানের, না এরদোয়ানের। সত্য নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা দেখছি, নিহত খাসোগিকে ঘুঁটি বানিয়ে এই তিন মাফিয়া বস স্রেফ জুয়া খেলতে বসে গেছেন।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

হামিদ দাবাশি: যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক