সংগীতমগ্ন এক শিল্পীর বিদায়

আইয়ুব বাচ্চু
আইয়ুব বাচ্চু

যাঁরা শিল্প–সংস্কৃতির চর্চা করেন, তাঁদের মধ্যে সংগত কারণেই মানুষ নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয় ইত্যাদির আশা করেন। কারণ, সংস্কৃতি তো জীবনাচরণেরই পরিশীলিত, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিফলন। শিল্পীরা একটু আত্মমগ্নই থাকেন, যে জন্য সবার মধ্যে এ গুণাগুণগুলো বিদ্যমান, এ কথা বলা যাবে না। তবে আত্মমগ্নতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা সমার্থক নয়। আইয়ুব বাচ্চু সংগীতচর্চায় মগ্ন থেকেও আত্মকেন্দ্রিকতামুক্ত একজন শিল্পী ছিল। যখনই দেখা হতো অত্যন্ত বিনয় ও সম্মানের সঙ্গে কথা বলত। বয়োজ্যেষ্ঠ তথা পূর্বসূরিদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে কখনো কুণ্ঠাবোধ করত না।

ব্যস্ততা থাকলেও তার মধ্যে কখনো অস্থিরতা দেখিনি। ব্যান্ড সংগীত বললেই আমরা যে এক অস্থির, বাদ্যযন্ত্রের ঝনাৎকারসর্বস্ব গানের কথা কল্পনা করি, বাচ্চুর সংগীতে তা ছিল না। এমনকি ওর আচার–আচরণেও আমি অস্থিরতা দেখিনি কখনো। আমাদের ব্যান্ড সংগীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সংগীতের যে অন্ধ অনুকরণ লক্ষ করা যায়, বাচ্চু সে প্রভাব থেকেও মুক্ত ছিল। অবশ্য এখানে এ–ও বলা প্রয়োজন, ঢালাওভাবে আমাদের ব্যান্ড সংগীত সম্পর্কে এসব অভিযোগ যথার্থ নয়। অনেকেই ভালো সৃজনশীল কাজ করছে। প্রাথমিক মোহগ্রস্ততা কাটিয়ে আমাদের ব্যান্ড সংগীত এখন অনেকটাই সংযত ও সচেতন।

বাচ্চুকে ব্যান্ড সংগীতের একজন পথিকৃৎ বা গিটারের জাদুকর, যে বিশেষণেই অভিহিত করা হোক না কেন, সবকিছু ছাপিয়ে সে একজন অসাধারণ কম্পোজার বা সুরকারও ছিল। তার সুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রশংসনীয় দিকটি হচ্ছে বাংলা মূলধারার গানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সমসাময়িক ধারাটির সৃজনশীল সমন্বয়। ‘তারাভরা রাতে...’ বা ‘এখন অনেক রাত...’ কী অপূর্ব মেলোডি! এসব গানের আঙ্গিকটি পাশ্চাত্যের হলেও হৃদয়টি পুরোপুরি বাংলা গানের। এখানেই তার কৃতিত্ব ও বৈশিষ্ট্য। সংগীত কোনো বদ্ধ জলাশয়ের নিশ্চল বস্তু নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার গতিময়তাও কাম্য। সমসাময়িক জীবন তথা রুচির সঙ্গে সখ্যও প্রয়োজন, তবে তা শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়। বাচ্চু এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে ধারণ করেও নিছক উত্তেজনাসর্বস্ব গান সে করেনি। তার গানে উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে বাংলা গানের মেলোডিক চরিত্রটি হারিয়ে যায়নি।

আমি তার সুরের অনুরাগী ছিলাম। তাই ওকে বলেছিলাম আমার একটি অ্যালবামের জন্য দুটি গান করে দিতে। ব্যস্ততার অজুহাত না দিয়ে সে আনন্দের সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল এবং যথাশিগগির করেও দিল। শুধু তা–ই নয়, নিজে থেকেই বলল, ‘আমি তনিমার (আমার মেয়ে) গান শুনেছি, ওর জন্য কিছু গান করব, ও তো আমাদেরই মেয়ে।’ আমি তার এই আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরো একটি অ্যালবামই করে দিতে বললাম। ও তখন অত্যন্ত ব্যস্ত। তবু এরই মাঝে কিছুদিনের মধ্যেই তার স্টুডিওতে তনিমার চমৎকার কিছু গান রেকর্ড করে দিল। দুঃখের বিষয়, যে প্রকাশনা সংস্থা গানগুলো নিয়েছিল, তারা কী এক অজ্ঞাত কারণে গানগুলো বাজারজাত করল না। যা–ই হোক, সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। বছর দু-এক আগে আরেকটি প্রকাশনা সংস্থা আগ্রহ নিয়ে গানগুলো প্রকাশ করেছিল। সেই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বাচ্চুও উপস্থিত ছিল। তনিমা গান গাইতে মঞ্চে উঠলে বাচ্চু নিজে থেকেই এসে গিটারটি নিয়ে বাজাতে শুরু করল, একজন কনিষ্ঠের প্রতি স্নেহ এবং আন্তরিকতার কী চমৎকার দৃষ্টান্ত!

বাচ্চু বেশ কয়েক বছর আগে টেলিভিশনে একটি গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপন করত। তার অনুরোধে আমি সেই অনুষ্ঠানে একদিন গাইলাম। প্রায় এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে কোনো মহড়া ছাড়াই বাচ্চু নিজেই তার গিটারের সুরের অলংকারে আমার গানগুলোকে সাজিয়ে দিল। গেয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, আজও তা ভুলবার নয়। অনুষ্ঠান শেষে যেভাবে সম্মান এবং শ্রদ্ধাভরে ও আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাল, তাতে আমি নিজেই সংকুচিত হয়ে গেলাম।

আরেকবার ওর তত্ত্বাবধানে একটি অনুষ্ঠানে ও আমাকে অনুরোধ করল গাওয়ার জন্য। আমি বললাম, ‘তুমি যদি আমার সঙ্গে বাজাও তাহলে গাইব।’ বাচ্চু তার স্বভাবসুলভ হাসিটি দিয়ে বলল, ‘আপনি না বললেও আমি বাজাব, আপনার সঙ্গে বাজানো আমার জন্য আনন্দের।’ এমন ছোট ছোট স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে আইয়ুব বাচ্চু—এক জাত শিল্পী, এক পরিপূর্ণ শিল্পী। শয়নে–স্বপনে যার ধ্যানজ্ঞান ছিল শুধুই সংগীত। তার এ অকস্মাৎ, অকালপ্রয়াণে আমাদের সংগীত অঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়। বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

সৈয়দ আব্দুল হাদী, সংগীতশিল্পী