ইথিওপিয়ার পালাবদলের সুফল পাচ্ছে নারী

ইথিওপিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করেছেন ১৬ অক্টোবর। দীর্ঘ এক মাসের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে গত এপ্রিলে দায়িত্ব নেন ৪২ বছর বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। তিনি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের (ইথিওপিয়ান পিপলস রেভল্যুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) দ্বারাই এ পদে অধিষ্ঠিত। আবি নিগৃহীত অরম জাতিগোষ্ঠীর নেতা এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফসল তাঁর বিজয়। ২০২০ সালে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন বলে তিনি শপথ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রতিজ্ঞা করেছেন, তিনি একটি নতুন ইথিওপিয়া উপহার দেবেন। আরও প্রতিজ্ঞা করেছেন, বহুধা বিভাজিত দেশটির সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সমতা আনবেন। তিনি নিজে অরম জাতিগোষ্ঠী থেকে আগত, যে অরমরা দেসেলেন একনায়কত্বের সময় নানা বঞ্চনার শিকার হয়।

গত এপ্রিলের আগে দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, গুম, হত্যা ও নির্যাতন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, সামাজিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ, ভিন্নমত দমন, জাতিগত দাঙ্গায় উসকানি—এসব ছিল গত এক দশকের ইথিওপিয়ার চালচিত্র। বিপরীতে সংস্কারবাদী প্রধানমন্ত্রী সব বন্দীকে মুক্তি দেন; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উন্মুক্ত করে দেন। আরও উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা এই যে আইনপ্রণয়নে নারীরা ব্যাপক হারে যুক্ত হচ্ছেন। ইথিওপিয়ার বর্তমান মন্ত্রিসভায় নারী মন্ত্রী ৫০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ মন্ত্রিসভা ২৮ জন থেকে কমিয়ে ২০ জনে নামিয়ে আনেন। তার মধ্যে অর্ধেক মন্ত্রীই হচ্ছেন নারী।

ইথিওপিয়ার সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। সাংসদেরা ফেডারেল, রিজিওনাল, ওয়ারেদা (জোনাল) এবং কেবেলা—এ চার পর্যায়ে কাজ করেন। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে এই যে বিগত ১৯৯৫, ২০০০, ২০০৫, ২০১০ ও ২০১৫ সালে নারী সাংসদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ১০ শতাংশ, ৭ দশমিক ৬৮, ২১ দশমিক ২১, ২৭ দশমিক ৭৯ এবং ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে যে ইথিওপিয়ায় ঐতিহাসিকভাবেই নারী ককাস শক্তিশালী এবং সাংসদ হিসেবে তাঁরা প্রশিক্ষিত। নারী সাংসদেরা সম্মিলিতভাবে মাতৃত্বকাল এবং তার আগে–পরের সময়ে কর্মক্ষেত্র থেকে পূর্ণাঙ্গ সুবিধাদি পাওয়ার অধিকার আদায় করেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে নারীদের নিজ নামে ভূমি রেজিস্ট্রেশন করার আইনপ্রণয়নেও তাঁরা ভূমিকা রাখেন।

১৯৫৪ সোলে পার্লামেন্টে প্রয়াত সিন্ধু গেব্রু নামক নির্বাচিত একমাত্র নারী সাংসদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘একদিন তোমরা দেখবে, অনেক নারী সাংসদ এ সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসবেন।’ ১৯৯৫-২০১৫ সালে নারী সাংসদের সংখ্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। ১৯৯৫ সালে পার্লামেন্টে যেখানে ৫২৬ জন পুরুষ সাংসদ ছিলেন, সেখানে নারী সাংসদ ছিলেন মাত্র ১১ জন। আর ২০১৫ সোলের সংসদে যেখানে ৩৩৫ জন পুরুষ সাংসদ আসেন, সেখানে নারী সাংসদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২১২ জন। আফ্রিকান অন্যান্য দেশ যেমন রুয়ান্ডাতে এ সংখ্যা ৬৩ শতাংশ, সেনেগালে ৪২ দশমিক ৩, দক্ষিণ আফ্রিকাতে ৪১ দশমিক ৭ এবং নামিবিয়াতে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ নারী সাংসদ রয়েছেন। ইথিওপিয়ান পিপলস রেভল্যুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় আসে এবং পাঁচটি সংসদ নির্বাচন করে। সেগুলো ছিল জবরদস্তিমূলক একতরফা এবং একদলীয় নির্বাচন। যার অনিবার্য পরিণতি ছিল সহিংস ইথিওপিয়া।

২০১৫ সালের ইথিওপিও সংসদে ৫৪৬ জন সাংসদ সরকারি দলের আর গিরমা সেইফু মারু ছিলেন একমাত্র বিরোধীদলীয় সাংসদ। সেটা ছিল দেসেলেনের একনায়কত্বের সময়। গিরমার সঙ্গে আমার দেখা হয় ২০১৬ সালের অক্টোবর এর প্রথম দিকে আদ্দিস আবাবাতে। গিরমা ফোড়ন কেটে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি যেমন একা, তাঁরাও (সরকারদলীয় সদস্যরা) একা।’ সে সময় ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছিল ব্যাপকভাবে; আর চীনা কোম্পানিগুলো উঁচু উঁচু অট্টালিকার নির্মাণকাজের একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়েছিল। আদ্দিস আবাবার নগর সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ড যে কারোরই চোখে পড়বে। অরম জাতিসত্তার মানুষদের বসতবাড়ি উচ্ছেদ করে ওই উন্নয়নযজ্ঞ চলছিল। গিরমার ভাষায়, ‘গত এক দশকে ইথিওপিয়ার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আকর্ষণীয়। কিন্তু এটি চৈনিক স্টাইলের কর্তৃত্ববাদ। যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, নাগরিক স্বাধীনতা–বর্জিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এ উন্নয়ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নীরব থাকে, গণমানুষের কথা এড়িয়ে যায়। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুষ্টিমেয় কিছু রাজনীতিককে আর্থিক সুবিধা দিয়ে খুশি করে রাখা।’

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটিতে আমরা আগ্রহী ছিলাম সংসদ, সাংসদ ও দারিদ্র্য বিমোচনে জনগণের অংশগ্রহণ বিষয় নিয়ে। ২০১৭ সালে আমাদের গবেষণার তথ্য দেখায় যে সংসদের ককাসে যে ১৭ জন নারী সাংসদ রয়েছেন, তাঁরা স্কুলে মেয়েদের শিক্ষার অগ্রাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তাঁরা সংসদে দাবি তোলেন যে রাষ্ট্রীয় পরিসরে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে এবং সংসদীয় কমিটিগুলোতে নারীর অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হবে। দেখা গেছে, নারী সাংসদদের শাণিত যুক্তির কারণে বাজেট প্রণয়নে নারী সাংসদদের অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোতে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করেছেন। বর্তমান মন্ত্রিসভাতে ৫০ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব করার যে চিত্র আমরা দেখি, তার ঐতিহাসিকতা বোঝা জরুরি।

২০১৬ সালে লক্ষ করি যে সরকারের নির্বাহী সেক্টরে নারীর সংখ্যা নগণ্য ছিল। ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৩০ জন মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র তিনজন নারী মন্ত্রী ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের গবেষণা সহযোগী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মন্ত্রিসভায় নারীর প্রতিনিধিত্ব এত কম কেন? প্রধানমন্ত্রীর দায়সারা উত্তর ছিল, ‘আগ্রহ কম থাকার কারণে শিক্ষিত নারীরা এগিয়ে আসছেন না।’ বেশির ভাগ সাধারণ নাগরিক আমাদের জানান যে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর এ জবাবে সন্তুষ্ট নন। কিন্তু বর্তমানে আমরা এর বিপরীত চিত্র লক্ষ করি।

আমরা কীভাবে এই পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করব? এটি কি শাসকগোষ্ঠীর একটি রাজনৈতিক কৌশল, যার লক্ষ্য হচ্ছে, ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা? এটি কি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লৈঙ্গিক সমতা বজায় রাখার প্রতি সম্মান দেখান? এটি কি ২০১৫ সালের মধ্যে রাজনীতির সর্বক্ষেত্রে নারীর ৫০ শতাংশ অংশগ্রহণ অর্জন করা—যার আহ্বান জানিয়েছিল আফ্রিকান ইউনিয়ন? নাকি নারী ভোটারদের সহানুভূতি পেতে এটি একটি আপৎকালীন পন্থা?

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আয়েশা মোহাম্মদকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আর নতুন সৃষ্ট শান্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন মুফুরিয়াত কামিকে। আয়েশা অনগ্রসর মুসলিম আফার অঞ্চল থেকে এসেছেন। এ ছাড়া কর ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন দুজন নারী সাংসদকে। সব মিলিয়ে আবি মন্ত্রিসভার বর্তমান নারী মন্ত্রীর সংখ্যা হচ্ছে ১০ জন। এক প্রতিক্রিয়াতে আবি আহমেদ জানান যে মন্ত্রিসভাতে ৫০ শতাংশ নারীর অন্তর্ভুক্তি শুধু ইথিওপিয়াতে নয়, বরং সমগ্র আফ্রিকাতে নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছে। চিরায়ত ধারণা যে নারী রাষ্ট্র পরিচালনে যোগ্য নয়, এ মিথ তিনি ভেঙেছেন।

ঐতিহাসিকভাবে ইথিওপিয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সাব–সাহারান আফ্রিকার মতোই এ দেশটিতে লৈঙ্গিক অসমতা প্রবল। লৈঙ্গিক সমতা স্থাপন বর্তমানে শুধু আফ্রিকাতে নয়, বিশ্বজুড়ে একটি ডিসকোর্সে পরিণত হয়েছে। রুয়ান্ডাতে নারী সাংসদের সংখা উত্তরোত্তর বেড়ে চলছে। সোমালিয়াতে আমরা দেখি যে ৩০ শতাংশ নারী সাংসদের জন্য নির্ধারিত, ১০ শতাংশ বেড়েছে ২০১৬ সালে। শুধু সংখ্যার বিচারে নারীর ক্ষমতায়ন পরিমাপ করা যায় না। ক্ষমতা ভারিক্কি কোনো বস্তু নয়, যা আধা পুরুষের মাঝে আধা নারীর মাঝে বণ্টন করতে হবে। বরং ক্ষমতা একটি গুণগত বিষয়, যা সমাজের সর্বত্র বিরাজমান। সমাজ–সংস্কৃতিতে পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শের বিপরীতে নারীর মতামত প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। ইথিওপিয়ার সংসদে এবং মন্ত্রিসভাতে নারীর সংখ্যা বাড়া কম অর্জন নয়। তবে বর্তমানের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাল্যবিবাহ, গেরস্থালিতে সহিংসতা এবং নারী পাচার রোধ করার মতো নারী অধস্তনতার বিষয়গুলোকে একেবারে সামনে নিয়ে আসা এবং পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। ইথিওপিয়ার সাম্প্রতিক নারীর ক্ষমতায়নের জলজ্যান্ত অভিজ্ঞতা আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য নতুন বার্তা নিয়ে আসবে বইকি।

ড. জহির আহমেদ: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। zahmed 69 @hotmail. com