সরকার ও দলের মধ্যে পার্থক্য ঘুচে গেছে

এমাজউদ্দীন আহমদ
এমাজউদ্দীন আহমদ
>
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের  রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ  সম্প্রতি প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। তাঁদের সাক্ষাৎকার নেন মিজানুর রহমান খান। 

প্রথম আলো: বিএনপি যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যায়, সে বিষয়ে আপনার পরামর্শ ছিল। ঐক্যফ্রন্ট করার পরে এটা কি এখন নিশ্চিত?
এমাজউদ্দীন আহমদ: ইতিমধ্যে পদ্মা-যমুনায় প্রচুর পানি গড়িয়ে গেছে। সেই চিন্তাভাবনা হয়তো এখন ধারণ করা সম্ভব হবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রকে বিধ্বস্ত করতে দুটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। রাষ্ট্র, সরকার ও দলের মধ্যে পার্থক্য ঘুচে গেছে। আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে মেধা ও দক্ষতা বাদ পড়েছে। দল ও নেতার প্রতি আনুগত্য হচ্ছে প্রধান মাপকাঠি। এভাবে পাঁচ বছর আগের ও পরের প্রধানমন্ত্রী ভীষণভাবে ভিন্ন হয়ে গেছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিরোধী দলের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।

প্রথম আলো: আপনি কি নির্দলীয় সরকার না হলে নির্বাচন বয়কটের যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দিতে পারে।

প্রথম আলো: নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার এই দুটি ইসির কাছে ন্যস্ত করার সুপারিশ করেছেন। তেমন কিছু হলে লাভ হবে কি? ইসির ওপর তো বিএনপির আস্থা নেই।
এমাজউদ্দীন আহমদ: এটুকু মেনে নেওয়া নিরঙ্কুশভাবে ন্যূনতম। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে বাদ দিয়ে সরকার করতে পারলে ভালো। ওটা হলে মন্দের ভালো, একটা কিছু অগ্রগতি বলা যাবে। নির্বাচনের আগে এসব বিষয় নিয়ে সংলাপ অপরিহার্য। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ, এটা সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশের অন্তরায়।

প্রথম আলো: খালেদা জিয়া কারাবন্দী, তারেক রহমান নির্বাসিত ও দণ্ডিত। বিএনপির জন্য এটা এক নতুন পরিস্থিতি। দল জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন? এটা খোলাসা করা এখন সম্ভব?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সম্ভব নয়। তবে ড. কামাল হোসেন বলেছেন, নির্বাচনের পরে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন হবেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটা আমারও মত। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।

প্রথম আলো: খালেদা জিয়ার কোনো একচ্ছত্র আসনে ড. কামাল হোসেন দাঁড়াতে পারেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমার তা মনে হয় না। তার কারণ তিনি অত দূর যাবেন বলে ধারণা করি না। বিএনপির নেতৃস্থানীয়দের ধারণা এমন নয় যে তিনি (ড. কামাল) ও রকম কোনো আসনে দাঁড়ালেই জয়যুক্ত হবেন। আমি তাঁকে ওই পর্যায়ে নামানোটা...

প্রথম আলো: তার মানে তাঁকে সংসদে আনাটা জরুরি নয়।
এমাজউদ্দীন আহমদ: না। তিনি নির্বাচনকালীন নেতা।

প্রথম আলো: তার মানে পরিবারের বাইরে একান্তই যেতে হলে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১০ নেতা থেকেই আসবেন? পাকিস্তানে নওয়াজ পরিবারের বাইরে প্রধানমন্ত্রী করতে পেরেছে। বাংলাদেশে হলে হবে প্রথম ব্যতিক্রম?
এমাজউদ্দীন আহমদ: হোপফুলি, ইয়েস। তাঁদের মধ্য থেকেই কেউ একজন প্রধানমন্ত্রীর পদ নেবেন। তবে এখনই সেটা উল্লেখ না করা ভালো।

প্রথম আলো: তারেক রহমানের ভবিষ্যৎ?
এমাজউদ্দীন আহমদ: তাঁর জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু তাঁর কিছুটা সময় দরকার। যদিও আমার ৮৪ বছর চলছে, সময় কম। তদুপরি আমি মনে করি তাঁর আরও কিছুটা প্রশিক্ষণ বা শিক্ষণের দরকার আছে। ওঁকেও বলেছিলাম আমি, যদি সময়-সুযোগ আসে, এই কাজটা আমি কিছুটা ভলান্টিয়ার করতে চাই।

প্রথম আলো: ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য টিকবে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: এটা একটি প্রক্রিয়া। কারাগারে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলার অনেক সুযোগ হয়েছে। তিনি দলের লোকজনকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। ৮০ হাজার মামলায় বিএনপির প্রায় ২০ লাখ নেতা-কর্মী আসামি। প্রতিনিয়ত আরও ধরপাকড় চলছে। এ জন্যও সংলাপ দরকার। মাঠ সমতল করতে সংসদ ভেঙে দিতেই হবে। সরকার বলছে, তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। বর্তমান সংবিধানের আওতায় সংসদ ভেঙে দেওয়া যাবে।

প্রথম আলো: ধরুন এসব অবস্থা বদলাবে না। সংসদ রেখেই নির্বাচন হবে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: কী করে তাহলে সব দলের অংশগ্রহণে অর্থপূর্ণ নির্বাচন হবে? তাহলে তো নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়া অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছিলেন। বিএনপি সংসদে না থাকলেও নির্বাচনী সরকারে বিএনপি থেকে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী করা যায়। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মুক্তির প্রক্রিয়া চালু থাকতে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়াতে এবং জনসভায় ভাষণ দিতে দিলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে।

প্রথম আলো: ঐক্যফ্রন্ট করার পরও নির্বাচন করার অঙ্গীকার করেনি বিএনপি। বরং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারি দলকে শুধু বৈধতা দিতে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। আবার অধ্যাপক হারুন–অর–রশিদ মনে করেন পুনরায় নির্বাচন বয়কট হবে বিএনপির কফিনে শেষ পেরেক।
এমাজউদ্দীন আহমদ: কোনো রাজনৈতিক দলের কফিনের প্রথম বা শেষ পেরেক বিষয়ক কোনো চিন্তাভাবনার দরকার নেই। এখন পর্যন্ত বিএনপি জনগণের দল। জনগণ ভোটের সুযোগ পেলে একটা বিপ্লব ঘটাতে পারে। এ জন্য ভোটকেন্দ্রে ভোটব্যবস্থা পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: না। ভোটকেন্দ্রে তাদের উপস্থিতির কথা বলছি। যাতে তারা ভোটাভুটি পর্বটির তদারক করতে পারে। বর্তমানের দলীয় অনুগত বেসামরিক প্রশাসনের প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই। আস্থার জায়গাটা সামরিক বাহিনীর ওপর এখনো আছে।

প্রথম আলো: ভারত-চীনের ভূমিকা কী হতে পারে? তবে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চীন কোনো ভূমিকা রাখবে না। আর বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে সরকারের ভারসাম্যের কূটনীতিকে অনেকে বলছেন প্রশংসনীয়। অনেকের ধারণা, আরেকটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন করার জন্যও তাকে আন্তর্জাতিক গঞ্জনা সইতে হবে না।
এমাজউদ্দীন আহমদ: চীনা অবস্থানের এই মার্কিন পাঠকে আমি অন্যভাবে দেখি। ভুটানেও চীন মিশন খুলছে। চীনের দ্বারা ভারত চারদিকে ঘেরাও হয়ে আছে, যেটুকু বাকি তা তারা সম্পূর্ণ করবে। সে কারণে ভারতের অবস্থান মাঝামাঝি হওয়া ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার কথা নয়। চীনা বিনিয়োগের সুদ গুনলে আমরা দেউলিয়া হব। আর সব বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার যে কথা বললেন, তার কোনো বিকল্প ছিল না। বিদেশি বন্ধুরা নিশ্চয় স্মরণ করাচ্ছেন যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন শোধরানোর অঙ্গীকার সরকার করেছিল। বিশ্বের অনেক বড় বড় স্বৈরতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্র বলতে পশ্চিমারা আপস করেন, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা এই আপস করবে বলে মনে হয় না। ঐক্যফ্রন্ট কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করল, তার দরকার ছিল না।

প্রথম আলো: আপনি গত নির্বাচন বয়কট সমর্থন করেছিলেন। বয়কট ঐতিহাসিক ভুল ছিল, স্বীকার করেন? কোনো দাবি মানা হবে না, আরও চাপ আসবে, তদুপরি বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া অর্থপূর্ণ হবে, বয়কট মানে ‘কফিনে শেষ পেরেক।’ মন্তব্য করুন।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ভুল ছিল না। কফিনে শেষ পেরেক, এটা খারাপ কথা। আমারই ছাত্র, আওয়ামী লীগের হয়ে বলেছেন। তবে নির্বাচন করার সুফল আছে। কারণ, হয় ১৫১ আসনে জিতে যাবেন, না হয় প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী হবেন। সুতরাং ওদিক থেকে বিএনপি লাভবানই হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ইংল্যান্ডে বিরোধী দলের নেতার সম্মানও অনেক উঁচুতে।

প্রথম আলো: অধ্যাপক হারুনের কথায় এমন ইঙ্গিত পাই, বিএনপি ২০০৮-এ যেহেতু ৩০টি পেয়েছিল। এবার বড়জোর ৬০ থেকে ১০০ আসন পেতে পারে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ২০০৮ সালের ওটা নির্বাচনই ছিল না, সামরিক কর্মকর্তাদের হিসাব-নিকাশ ছিল। যেটা বলছেন, সেটা আওয়ামী লীগের জন্যই হয়তো খাটে। ১৯৯১ সালে তারা সর্বোচ্চ ৮৮ আসন পেয়েছিল। এখন তো ঘাটতি পড়ার কথা। জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ অশিক্ষিত, ২২ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা, সাম্প্রদায়িকতা বাড়ানো এবং সর্বোপরি ভয়ংকর এক হিংসাশ্রয়ী সমাজের উত্থানের জন্য যারা দায়ী, তাদের ভোট বৃদ্ধির সুযোগ আমি দেখি না।

প্রথম আলো: বিরোধী দলের নেতার আসন বিএনপির না হয়ে জাতীয় পার্টির হলে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সেটা কী করে হবে? বিএনপি হয় এক নম্বর বা দু নম্বর হবে। তিন নম্বর তো হবে না। কান পেতে শুনুন, লোকে কী বলছে।

প্রথম আলো: পুরো সাক্ষাৎকার একটি বাক্যে বললে কী বলবেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: সুশাসন ও স্বশাসনের বড্ড বেশি আকাল। বর্তমান সরকার এই দুটি ক্ষেত্রে কিছুটা অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ নিলে জাতি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ধন্যবাদ।