ঐক্যফ্রন্ট বিএনপির পুনর্বাসন কেন্দ্র

হারুন–অর–রশিদ
হারুন–অর–রশিদ
>

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী  জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ সম্প্রতি প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। তাঁদের সাক্ষাৎকার নেন মিজানুর রহমান খান।

প্রথম আলো: ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন দিয়ে পাঁচ বছর চালানোর নৈতিকতা নিয়ে আপনিও প্রশ্ন তুলেছিলেন। বেশ তো কেটে গেল।
হারুন-অর-রশিদ: একটা চরম বৈরী পরিবেশে ওই নির্বাচন যে একতরফা হলো এবং পাঁচ বছরের একটি মেয়াদ যে পূরণ হতে পারল, সে জন্য বিএনপিই দায়ী। আগাম নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি দল নিজ গরজে তো দেবে না, এটাই রাজনীতি।

প্রথম আলো: বিএনপির অন্তত ৩০ ভাগ ভোটব্যাংক ছিল। তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে না কমেছে?
হারুন-অর-রশিদ: আরেকটি ভোট না হলে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। ধারণা করি, ২০১৫ সালে তাদের ৯৩ দিনব্যাপী সহিংস কর্মকাণ্ডসহ আরও কিছু ঘটনায় তাদের জনপ্রিয়তা আরও কমেছে। জনবিচ্ছিন্নতা বেড়েছে।

প্রথম আলো: বিএনপি এত দুর্বল হলে তাদের সভা–সমাবেশে এত বাধাদান কেন? ‘গায়েবি মামলা’ বাড়ছে?
হারুন-অর-রশিদ: বিরোধী দলের সভার অধিকার সব সময় থাকে। কিন্তু জামায়াতের মতো ছোট দলও দেখাচ্ছে যে তারা নাশকতায় পারঙ্গম হতে পারে। বিএনপির অতীত সহিংসতাসহ সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করেই বাংলাদেশের রাজনীতির গতি–প্রকৃতি মূল্যায়ন করতে হবে।

প্রথম আলো: তাহলে অনেকের মতে ‘দোআঁশলা’ গণতন্ত্র, যা অধিকতর কর্তৃত্ববাদী, সেটাই আমাদের নিয়তি কি না?
হারুন-অর-রশিদ: রাজনীতি–সংশ্লিষ্টরা যত দিন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও অনুশাসন অনুশীলন না করে, তত দিন কমবেশি এই অবস্থা চলমান থাকবে।

প্রথম আলো: গত ৯ মাসে ৪০৩ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ৫৮ গুম কিসের লক্ষণ?
হারুন-অর-রশিদ: এসব ঘটনা গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী কেউ সমর্থন করতে পারে না। তদুপরি কেন এসব ঘটছে, তা বুঝতে গভীর ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

প্রথম আলো: যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের নিষিদ্ধকরণে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা নীরব, আবার কে তার সঙ্গে জোট করল, সে বিষয়ে তারা সরব। এই স্ববিরোধিতাকে কীভাবে দেখেন?
হারুন-অর-রশিদ: রাজনীতি সম্পূর্ণ নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত তা নয়। কিন্তু রাজনীতি রাজনীতিই। সেখানে নানা বিষয়, নানা কুশীলব থাকেন। এই কুশীলবেরা রাজনীতিতে নানা ভূমিকা নানাভাবে মঞ্চস্থ করেন। দলটি নিষিদ্ধ হওয়া একান্ত আবশ্যক। সরকারি মহল বলছে, এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, কতটা প্রলম্বিত হবে, সেটা তারাই ভালো জানে।

প্রথম আলো: তাহলে সরকারের সেই অপারগতার কারণে জামায়াত কারও জোটে থাকা অবৈধ?
হারুন-অর-রশিদ: সন্ত্রাসী দল হিসেবে তার নিবন্ধন নেই, সেখানে সরকার কী করল বা করল না, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির ২০–দলীয় জোট গঠন করা। বিএনপি তাদের মন্ত্রিত্ব দিয়েছিল। কোন দল কী করল বা না করল, সেটা দিয়ে তো নীতিনির্ধারণ চলবে না। নীতি হতে হবে দলের আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। জামায়াতকে সঙ্গে রাখা কেউ সমর্থন করতে পারে না।

প্রথম আলো: সব অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে তো? সংসদ রেখেই কেন নির্বাচন করতে হবে?
হারুন-অর-রশিদ: ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে নির্বাচনটি হতে পারে। এতে সব দল অংশ নেবে। সংসদ রেখে নির্বাচন করার বিধান বাহাত্তরে ড. কামাল হোসেন যেটা করেছিলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীতে সেটাই ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

প্রথম আলো: আপনি আংশিক বলছেন, কারণ ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী চাইলে সংসদ রেখে বা ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে পারেন।
হারুন-অর-রশিদ: সংবিধান তা বলেনি। প্রধানমন্ত্রীর ওপরই নির্ভর করছে না। সংবিধানে দুটি বিকল্প আছে। সংসদের প্রথম বৈঠক থেকে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে করতে পারবে। আর কোনো কারণে সংসদ বিলুপ্ত হলে বিলুপ্ত হওয়ার ৯০ দিন পরে পারবে। এখন সংসদ রেখে নির্বাচন চাইলে সংবিধানের সংশোধনী লাগবে।

প্রথম আলো: লাগবে বলে মনে হয় না। আপনি যাকে ‘কোনো কারণে’ বলছেন, সেটা প্রধানমন্ত্রীর একক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। কারণ ৭২(১) অনুচ্ছেদ বলেছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ পাওয়া মাত্র সংসদ ভেঙে দেবেন। ব্রিটেন শতাব্দীকাল ধরে তা–ই করছে। কেন আপনি মনে করেন, সংসদ রেখে করাটাই গণতান্ত্রিক?
হারুন-অর-রশিদ: রাখা গণতান্ত্রিক, না রাখা অগণতান্ত্রিক—এর কোনোটিই আমি বলিনি। আসন্ন নির্বাচনে এটা মুখ্য বিষয় নয়। নির্বাচনের তফসিল দিলে সংসদ আর অধিবেশনে বসবে না। এটা নামমাত্র হয়ে যাবে। সামরিক শাসনামলে ভোট কারচুপি, আসন ভাগাভাগির কলঙ্ক আমরা সবাই জানি। কিন্তু সামরিক আমলের মতো এখন আর নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি এসেছে, নাগরিক সচতেনতা বেড়েছে। কোনো দলের যদি গণভিত্তি থাকে, তাহলে সরকার ইচ্ছা করলেও খুব একটা কিছু করতে পারে না। সিলেটের মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়যুক্ত হয়েছেন।

প্রথম আলো: যেহেতু কোনো জনমত জরিপ নেই, তাই বলি, পাঁচটি আসনের (সিটি নির্বাচন) যদি একটিতে বিএনপি জয়ী হয়, তাহলে তিন শ আসনে বিএনপি কয়টি পেতে পারে?
হারুন-অর-রশিদ: এটা কঠিন প্রশ্ন। তবে আমি বলব, ২০০৮ সালে তারা ৩২ আসন পেয়েছিল, এবার কটি পাবে নির্বাচনই বলে দেবে। আবার ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, তা নয়। ২০১৪ সালের আগে তারা বিপর্যস্ত ছিল, গত পাঁচ বছরে আরও বিপর্যস্ত হয়েছে। এর প্রমাণ, তাকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ঢুকতে হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের কাছে ঐক্যফ্রন্ট হলো পুনরুত্থান ও পুনর্বাসনের একটি অবলম্বন। গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মহাজোট যে অসাধারণ উন্নয়ন সাফল্য পেয়েছে, তা তাদের অতি বড় শত্রুরাও স্বীকার করবে। সে কারণে সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান এই সরকারের ধারাবাহিকতার কথা বলেছেন, এটা সৌজন্যসূচক নয়।

প্রথম আলো: বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের তরফে এমন কথা কি কূটনৈতিক রীতিনীতি সিদ্ধ? ভারতের সংবাদমাধ্যম সূত্রে অনেকে মনে করেন, দিল্লির মনোভাব ঈষৎ পরিবর্তিত? চীনা মনোভাব?
হারুন-অর-রশিদ: এটা বিশ্বায়নের যুগ। আমেরিকার নির্বাচনে হিলারি নাকি ট্রাম্প হবেন, সে বিষয়ে আমরা মতামত দিই সুতরাং এটা হস্তক্ষেপ নয়। আর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় এবং এই ভূখণ্ড ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করাসহ সামগ্রিক বিবেচনায় বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজমান, ভারত তার পক্ষে থাকবে বলেই প্রতীয়মান হয়। নানা কারণে ভারতের সঙ্গে আমাদের একটি বিশেষ সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত না চাইলেও একটা প্রভাব রয়েছে। চীনের অনুকূল মনোভাবেও কোনো পরিবর্তন নেই। চীন-মার্কিন সম্পর্কের যে টানাপোড়েন, সেখানে মার্কিনরা ভারতকে অগ্রাহ্য করবে বলেও মনে করি না। ভারতের অবস্থানই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক। আবার বাংলাদেশে চীনের বিরাট স্বার্থ রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতিতে সরকার শতভাগ সফল।

প্রথম আলো: গত নির্বাচনকালীন সরকারে পাঁচটি মন্ত্রণালয় বিরোধী দলকে দিতে আওয়ামী লীগ আন্তরিক ছিল কি? থাকলে এবার জাতীয় পার্টি পাবে? দলটি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসনে সমান দোষী ছিল, স্বৈরাচার ছিল।
হারুন-অর-রশিদ: সরকারপ্রধান বিএনপিকে নিয়েই নির্বাচন এবং পাঁচটি মন্ত্রণালয় দিতে আন্তরিক ছিলেন। জাপা না সরকারি, না বিরোধী দল। এখনো বিএনপিই প্রধান বিরোধী দল। বিএনপির উচিত ছিল জামায়াত থেকে বেরিয়ে সর্বতোভাবে স্বাধীনতাপন্থী একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে নতুন করে শুরু করা। তারা নিজেদের বদলায়নি। তাই বলি, এখন পর্যন্ত ১৪–দলীয় জোট ছাড়া বিকল্প নেই।

প্রথম আলো: বিএনপি প্রধান বিরোধী দল হলে তাদের ও তাদের সমর্থকদের নির্বিচারে স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি বলাটা রাষ্ট্রের জন্য ভায়াবেল কি না?
হারুন-অর-রশিদ: এটা একটা বাস্তবতা। আমরা কোদালকে কোদাল বলব। ঐক্যফ্রন্ট কোনো কর্মসূচিগত ঐক্যের ফসল নয়, এটা নেতিবাচক জোট, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই এর লক্ষ্য।

প্রথম আলো: তাহলে প্রশ্ন উঠবে, নির্বাচন কেন?
হারুন-অর-রশিদ: মাহাথির মোহাম্মদ ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আমাদের ১৪ দলের মতোই ১৯৫৫ সালে জাপানে এলডিপি জোট করে ক্ষমতায় এসেছিল। সেই থেকে গত ৬৩ বছরের মধ্যে মাঝখানে কয়েকটি বছর বাদ দিলে সেই এলডিপিই ক্ষমতায় আছে। তাতে কিন্তু গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকেনি। উন্নয়নেরও বিঘ্ন ঘটেনি। উপরন্তু ওই সব দেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকারীর ইন্ধনদাতাদের রক্ষাচেষ্টা, জাতির পিতাকে হত্যার পরে বিচার বন্ধে আইন পাস বা ২১ আগস্টের মতো গ্রেনেড হামলা ঘটেনি। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের একটা প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে।

প্রথম আলো: ধরুন, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বয়কট করল, ঢাকা সিটিতে তারা ভোটের দিনে বর্জন করেছিল।
হারুন-অর-রশিদ: বিএনপির দ্বিতীয়বার সাধারণ নির্বাচন বয়কট হবে বিএনপির কফিনে শেষ পেরেক।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন-অর-রশিদ: ধন্যবাদ।