মানহানি অপরাধের বিচার

‘আপনি একজন ঘৃণ্য নারীবিদ্বেষী। আমরা সারা পৃথিবীর কাছে এটা দেখাব যে কী ধরনের ডাহা জোচ্চর আর মিথ্যাবাদী আপনি।’

ওপরের কথাগুলো বলা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে। তাঁর নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে এ কথাগুলো বলেছেন পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলের আইনজীবী। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মানহানি মামলা হয়নি। ট্রাম্পের পূর্বসূরি ওবামার ওপর ক্ষিপ্ত মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য ওবামার নামে বের করা হয়েছিল টয়লেট টিস্যু। এ জন্যও কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।

বাংলাদেশে আমরা এমন পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করতে পারি না। বাংলাদেশের মতো দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বরং মানহানি মামলা হয় শক্তিমানদের পক্ষে, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে। অথচ এটি মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বাদ দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে। আমেরিকা বা ইউরোপের উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানহানির মামলা সাধারণত হয় বরং প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে অসাধারণদের সম্পর্কে কিছু বলার জন্য মানহানি মামলা হয়েছে এটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা সেখানে।

সাধারণ মানুষেরা মানহানি মামলা করলেও যে সেসব দেশের আদালত খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে তা–ও নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা এই অভিযোগ খারিজ করে দেয় বাক্স্বাধীনতার স্বার্থে। ১৯৬৪ সালে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট নিউইয়র্ক টাইমস বনাম সুলিভান মামলায় রায় দিয়েছিল যে কিছু মানহানিকর বক্তব্য বাক্স্বাধীনতা দ্বারা সংরক্ষিত। মানহানিকর বক্তব্যেরÿ ক্ষেত্রে এটিই আমেরিকার এবং পশ্চিমা বিশ্বের আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি।

উন্নত বিশ্বে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডে মানহানি লঘু একটি অপরাধ। মানহানি সেখানে দেওয়ানি অপরাধ, অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি হয় তাই শুধু অর্থদণ্ডে। মানহানি অপরাধের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা জামিন না দিয়ে আটক করে রাখা অকল্পনীয় বিষয় সেখানে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (পরে কাউন্সিল) তার বহু পর্যবেক্ষণে মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৯ ধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কমিশনের মতে, মানহানি মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলে তা অপব্যবহারের বহু সুযোগ থাকে এবং সেটি হলে মানুষ স্বাধীনভাবে ন্যায্য কথা বলতেও ভয় পায়।

মানহানিকে ডিক্রিমিনালাইজেশন (ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে অব্যাহতিকরণ) করছে বহু দেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কাও রয়েছে এর মধ্যে।

২.
মানহানি সম্পর্কে বাংলাদেশের আইন ভিন্ন, আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি আরও ভিন্ন। বাংলাদেশের আইনে মানহানি দেওয়ানি এবং একই সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধ। তবে ফৌজদারি হলেও এটি বাংলাদেশের আইনেও লঘু একটি অপরাধ। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড। ফৌজদারি কার্যবিধির ২ নম্বর তফসিল অনুসারে এটি জামিনযোগ্য, আমল–অযোগ্য এবং আপসযোগ্য অপরাধ।

আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে এ ধরনের লঘু একটি অপরাধকেই বাংলাদেশে ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র বানিয়ে ফেলা হয়েছে এর অপপ্রয়োগের মাধ্যমে। সাম্প্রতিক কালে মানহানি মামলার শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন সম্পাদক, সাংবাদিক, সমাজের বরেণ্য ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলাগুলো করা হয়েছে সরকারের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বলার অভিযোগে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুসারে মানহানির মামলা করার অধিকার রয়েছে শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির। অথচ গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী এমনকি দলের সঙ্গে কোনোরকম সংস্রবহীন ব্যক্তি মানহানি মামলা করেছেন অন্যের বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্যের অভিযোগ তুলে।

মানহানি মামলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে একই অভিযোগে একাধিক মামলা গ্রহণ। আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৫ঘ ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই বিষয়ে থানায় এবং আদালতে দুটো ভিন্ন মামলা হলে আদালতের মামলাটি স্থগিত থাকে। এই বিধানের পেছনে যে চিন্তাগুলো কাজ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে একই ঘটনায় কোনো মানুষকে বারবার ভোগান্তিতে না ফেলা এবং ভিন্ন সিদ্ধান্তের অবকাশ না রাখা। ‘নো পারসন শুড বি ভেক্সেড টোয়াইস’ নামে যে ন্যায়বিচারের সূত্র রয়েছে, তাতেও একটি ঘটনায় একাধিক মামলার কোনো অবকাশ নেই।

বাংলাদেশে খুনের মতো জঘন্য অপরাধেরও আমরা সাধারণত একাধিক মামলা দায়ের করতে দিতে দেখি না। তাহলে মানহানির মতো লঘু অপরাধে কীভাবে একই অভিযোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মামলা গ্রহণ করে আদালতগুলো?

৩.
মানহানি মামলায় তবু এত দিন আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না দিয়ে সমন দিত, আসামিকে জামিন দিতেও কোনো কার্পণ্য করত না। আইনে তা–ই করার কথা বলা আছে। কিন্তু সম্প্রতি আইনজীবী মইনুল হোসেনের ক্ষেত্রে এসব আইনও অনুসরণ করা হয়নি। তিনি একজন সাংবাদিককে টিভি টক শোতে ‘চরিত্রহীন’ বলার মতো অত্যন্ত আপত্তিকর একটি মন্তব্য করেছেন। এ জন্য অবশ্যই বিচার চাওয়ার অধিকার আছে আক্রান্ত সাংবাদিকের, এই বিচার হওয়াই উচিত। কিন্তু এ বিচারপ্রক্রিয়ায় এমন কিছু অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি।

ক. আমি আগেই ব্যাখ্যা করেছি ন্যায়বিচারের স্বার্থে একটি অভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা হয় না। বিশেষ করে বাদী নিজে সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করার পরে আইনজীবী মইনুলের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে অন্যদের মামলা দায়েরের কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। পরবর্তী মামলাগুলো আমলে নেওয়ার আগে আদালতগুলো অন্তত তদন্তের আদেশ দিতে পারত সিআরপিসি সেকশন ২০২ অনুসারে।

খ. ২০১১ সালের ১ নম্বর আইনে ফৌজদারি কার্যবিধির ২ নম্বর তফসিলের ৪ নম্বর কলামে যে পরিবর্তন আনা হয় তাতে মানহানির অভিযোগের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্টের পরিবর্তে সমন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তনের পর মানহানির অভিযোগে মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে হাজির হওয়ার সমন না দিয়ে প্রথমেই গ্রেপ্তারের পরোয়ানা দেওয়া অযৌক্তিক ও নজিরবিহীন।

গ. দণ্ডবিধির ৫০০ ধারার অধীন দায়েরকৃত মানহানি মামলা একটি জামিনযোগ্য অপরাধ। জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন পাওয়া আসামির অধিকার। এমন একটি অপরাধে মইনুল হোসেনের জামিন মঞ্জুর না হওয়া শুধু অযৌক্তিক নয়, অস্বাভাবিকও। যে অপরাধ আমল–অযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আদালতের অনুমোদন ছাড়াই আপসযোগ্য, সেখানে জামিনের আরজি বাতিল হয় কীভাবে?

মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে এই প্রশ্নসাপেক্ষ সিদ্ধান্তগুলো হয়েছে দণ্ডবিধির অধীনে দায়েরকৃত মামলায়। এখন তাঁর বিরুদ্ধে মানহানি মামলা হয়েছে অতি বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও। এই আইনে মানহানির মতো লঘু অপরাধকে অজামিনযোগ্য, আমলযোগ্য এবং তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়ার মতো বড় অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

আমার প্রশ্ন: যে অপরাধকে এমনকি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে না দেখানোর দায়দায়িত্ব রয়েছে ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তিটিতে, যে অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা বাদ দিচ্ছে একের পর এক রাষ্ট্র, সেখানে আমরা এই অপরাধকে আরও অনেক বেশি গুরুতর ও ভয়ংকর ফৌজদারি অপরাধ দেখিয়ে কীভাবে আইন করি?

লঘু আইনই কী কঠোর আর অস্বাভাবিকভাবে প্রয়োগ হতে পারে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে, তা আমরা মইনুল হোসেনের উদাহরণে দেখছি। এর সঙ্গে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ভয়ংকর বিধান যোগ হলে সমাজে এমনকি ন্যায্য কথা বলার ঝুঁকিও কেউ আর নেবে না।

৪.
মইনুল হোসেনের মানহানি মামলার পর উচ্চ আদালতের কাছে কিছু বিষয় পরিষ্কারভাবে আমাদের তুলে ধরা উচিত। একই অভিযোগে একাধিক মামলা হতে পারে কি না? মানহানি মামলায় সংক্ষুব্ধ বলতে আসলে কাদের বোঝাবে? সমন দেওয়ার এবং জামিন দেওয়ার আইন থাকলে নিম্ন আদালত তার ব্যত্যয় ঘটাতে পারে কি না?

মইনুল হোসেনের বিচার আমরাও চাই। কিন্তু তা করতে হবে তাঁর আইনগত অধিকার রক্ষা করে। এসবের ব্যত্যয় বিনা প্রশ্নে মেনে নিলে মানুষের অধিকার রক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগকে আরও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার সুযোগ পাবে সরকার।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক