সুবচন নির্বাসনে

তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস সেভেন কিংবা এইট। শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে—এসব পড়ে নজর গেল বড়দের বইয়ের দিকে। হাতে এল চরিত্রহীন। বইয়ের নামটির আকর্ষণ ওই বয়সে উপেক্ষা করতে পারিনি। পড়া শেষ করে বুঝতেই পারলাম না কোন চরিত্রটি ‘চরিত্রহীন’। এর 

অনেক বছর পর বইটি আবারও পড়েছি। বোঝার চেষ্টা করেছি।

শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, পথের দাবি ইত্যাদি গুটিকয় বই ছাড়া তাঁর প্রায় সব উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো নারী। চরিত্রহীন কিংবা আঁধারে আলো পড়ে ওই উপন্যাসগুলোর নারী চরিত্রকে নিয়ে কোনো নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়নি। বরং একধরনের সহানুভূতি এবং ভালোবাসা জন্মেছিল। কিন্তু বাঙালির মনস্তত্ত্বে ‘চরিত্রহীন’ শব্দটি একটি ‘গালি’। আমাদের সমাজে আমরা অহরহ এই গালি শুনে অভ্যস্ত। এসব শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার থেকে বোঝা যায়, আমরা ‘সভ্যতা’র কোন পর্যায়ে আছি।

অন্যকে গালমন্দ করা বাঙালির এক উপাদেয় মানসিক খাদ্য বা বিনোদন বললে বোধ করি ভুল হবে না। ঘরোয়া আসরে আমরা অনেকেই অনেক বেফাঁস কথা বলে থাকি। তার কতটুকু সাহিত্যের উপাদান হবে বা জন-আলোচনায় আসবে, তা নিয়ে আছে নানা মত, নানা বিতর্ক। পর্নো-সাহিত্য আদৌ সাহিত্য কি না, এ নিয়েও মতভেদ আছে। এরপরও একশ্রেণির পাঠক ও শ্রোতা এ ধরনের লেখা ও কথা হজম করতে পারেন। অনেকে পারেন না।

ভাষা ব্যবহারে আমরা নানান কারিকুরি করি। নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে আমাদের আছে নানান সংস্কার। অনেক হোটেলের কামরা কিংবা বাড়ি ভাড়া করতে গেলে সেখানে লেখা থাকে বা আগাম বলে দেওয়া হয়, ‘কোনো রকম অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকা চলিবে না’। অর্থটি আমরা বুঝি। যেকোনো ধারণা কিংবা বিষয় শোভনীয়তার সীমা না ডিঙিয়েও আলোচনা করা যায়। যাঁরা পারেন না, তঁাদের সমালোচনা বা ধিক্কার শুনতে হয়।

আমাদের দেশে আলাপ-আলোচনার জন্য আছে নানান প্ল্যাটফর্ম। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের অবস্থান সবার ওপরে। সেখানে সবাই এক রকমভাবে কথা বলেন না। কেউ কথা বলেন শান্তভাবে। কারও কথায় মার্জিত রুচির ছাপ থাকে স্পষ্ট। আবার কেউ কেউ অাঙুল উঁচিয়ে, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আস্তিন গুটিয়ে চেঁচামেচি করেন, দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কণ্ঠ থেকে উগরে দেন বিষ। সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার সুবাদে আমরা আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবকদের এসব বয়ান নিয়মিত শুনছি। এ থেকে শেখা কিংবা একে উপেক্ষা করা যার যার এখতিয়ার। তবে একটা কথা বলা চলে, সব সিনেমা যেমন পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে দেখা যায় না, জাতীয় সংসদের সব আলোচনাও সব সময়ে সবাইকে নিয়ে দেখা ও শোনা যায় না।

এখানে পাকিস্তান গণপরিষদের বিতর্কের একটি উদাহরণ উল্লেখ করতে চাই। বিতর্কটি হয়েছিল গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানের একটি শব্দ ব্যবহার করা নিয়ে। দিনটি ছিল ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার। বেলা আড়াইটায় করাচির গণপরিষদ ভবনে স্পিকার আবদুল ওহাব খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে আলোচনার একপর্যায়ে একজন সদস্যের বয়সের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন:

অনুগ্রহ করে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। পূর্ব বাংলার বয়োবৃদ্ধ লোকটির প্রতি আমার আবেদন, কারণ আমি তাঁকে সম্মান করি।

স্পিকার: অর্ডার, অর্ডার। আমি পূর্বেই বলেছি যে এই সংসদের কোনো মাননীয় সদস্যকে এভাবে সম্বোধন করতে পারেন না।

শেখ মুজিবুর রহমান: স্যার, আমি তাঁকে ‘বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি’ বলেছি; অন্য কিছু বলি নাই।

স্পিকার: এটা একটি অশোভন শব্দ; একজন মাননীয় সদস্যের জন্য মানানসই নয়।

শেখ মুজিবুর রহমান: তিনি একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি এবং আমি তাঁকে সম্মান করি। আমি তাঁকে ‘পাকিস্তানের বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি’ বলে ডাকব।

স্পিকার: আমি অবাক হয়ে গেছি যে মাননীয় সদস্য পুনরায় একই শব্দ ব্যবহার করেছেন।

শেখ মুজিবুর রহমান: ঠিক আছে; এই সংসদের একজন সম্মানিত সদস্য অথবা পাকিস্তান সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি তাঁকে অনুরোধ করতে চাই। স্যার, আপনি পূর্ব বাংলার লোকদের বলেছেন যে করাচি হবে কেন্দ্রীয় রাজধানী। কিন্তু এখন স্যার তারা করাচিতে রাজধানী রাখছে না। তাই আপনার কাছে আবেদন, করাচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী রাখুন। অন্যথায় আপনিই পরিণতির জন্য দায়ী থাকবেন। ধন্যবাদ।...

তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপোড়েন চলছিল। যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক শত্রুতার ছাপ কথাবার্তায় তত তীব্র ছিল না। যেমনটি এখন দেখি। এখন তো সমালোচনা আর গালাগাল একাকার হয়ে গেছে। একটি পক্ষ যদি মনে করে তারা ধোয়া তুলসীপাতা, অন্য পক্ষটি তাদের চোখে ষড়যন্ত্রকারী। এক পক্ষের জন্য যা ‘কৌশল’, অন্য পক্ষের কাছে তা হলো ‘চক্রান্ত’।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন বাঙালির চরম বৈরী। তবু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের সম্বোধন করতেন ‘জনাব ইয়াহিয়া খান’ এবং ‘ভুট্টো সাহেব’ বলে। প্রতিপক্ষকে গালাগাল করে নিজেকে মহিমান্বিত করা যায় না। এখন তো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ‘আপনি’-‘তিনি’ সম্বোধন প্রায় উধাও। তুই-তোকারি চলে যখন-তখন। সংসদের কার্যবিবরণী থেকে যেসব বাক্যবাণ এক্সপাঞ্জ হয়েছে, তার একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হতো।

অনেক ছোট ও মাঝারি গোছের রাজনৈতিক নেতা মনে করেন, প্রতিপক্ষ দলের বড় নেতাকে কষে গাল দিতে পারলে তাঁর দলের বড় নেতা খুশি হবেন। ফলে গালাগালের এমন এক মচ্ছব শুরু হয়ে গেছে যে এটা কীভাবে থামবে, কেউ জানে না। সামনে নির্বাচন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বড় দালানটায় ঢুকতে চান অনেকেই। কী বললে নেতা খুশি হবেন, এই ভেবে তাঁরা এখন কণ্ঠে শাণ দিচ্ছেন। রাজনীতির ভাষা দিন দিন তলানির দিকে যাচ্ছে। বাংলার শব্দভান্ডারে যে এত বিশেষণ আছে, তা এত দিন যেন অনাবিষ্কৃত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে কবিতা ও মঞ্চনাটকে জোয়ার এসেছিল। ওই সময়ের একটি নাটক হলো সুবচন নির্বাসনে। থিয়েটারের এই নাটকটি লিখেছিলেন আবদুল্লাহ আল–মামুন। এখন রাজনীতির যা হালহকিকত, তাতে মনে হয় নাটকের ওই শিরোনামটিই প্রতীকী অর্থে ফিরে এসেছে।

সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শিশু-কিশোরদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু অশ্রাব্য স্লোগান ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ওই সব কুৎসিত স্লোগান দেওয়া হতো। এটা ছিল একটা স্যাবোটাজ। তারপরও বলব, রাজনীতি যেমন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, রাজনীতির ভাষাও হয়ে পড়েছে নিম্নগামী। আমরা যেন রুচিহীনতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি দিন দিন। আমাদের রাজনৈতিক চরিত্রের অধোগতি দেখে দুঃখ হয়। এ জন্যই কি আমরা বুকের রক্ত ঢেলে দেশটি স্বাধীন করেছিলাম?

এরপরও উঠে দাঁড়াতে হবে, আশায় বুক বাঁধতে হবে। হেরে গেলে তো চলবে না। রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে বলব:

চলার পথে কাঁটা থাকে

দ’লে তোমায় যেতেই হবে।   

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক