রাজাপক্ষেকে ক্ষমতায় বসাল চীন!

মাহিন্দা রাজাপক্ষে। ছবি: রয়টার্স
মাহিন্দা রাজাপক্ষে। ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কা আবারও একটি রাজনৈতিক খাদের মধ্যে পড়ে গেল। গত শুক্রবার দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে নাটকীয়ভাবে বরখাস্ত করে তাঁর জায়গায় মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে বসিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে অনিশ্চয়তার দিকে চলে গেছে।

২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপক্ষের সব বিরোধী শক্তির সমর্থন নিয়ে তাঁকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছিলেন সিরিসেনা। সেই সময় বিক্রমাসিংহের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন সিরিসেনা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় দৃশ্যপট বদলে গেছে। তখনকার শত্রু রাজাপক্ষেকেই এখন বুকে টেনে নিয়েছেন সিরিসেনা। আর সাবেক মিত্র বিক্রমাসিংহেকে চরম শত্রুজ্ঞানে ছুড়ে ফেলেছেন।

এটা ঠিক যে সিরিসেনা এবং বিক্রমাসিংহের মধ্যে বরাবরই বেশ কিছু বিষয়ে সাংঘাতিক মতবিরোধ ছিল। কিন্তু সেই বিরোধ যে এমন পর্যায়ে চলে আসবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি। শুক্রবারে যা হয়ে গেল, তা শ্রীলঙ্কায় যে বড় ধরনের সাংবিধানিক সংকট তৈরি করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর কারণ হলো সিরিসেনা যে কায়দায় বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করেছেন, তা সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সংশোধনীতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, পার্লামেন্টে ভোটাভুটি ছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট বরখাস্ত করতে পারবেন না। বাস্তবতা হলো পার্লামেন্টে ভোট হলে বিক্রমাসিংহেকে সরানো যাবে না। কারণ, সিরিসেনার দল ইউনাইটেড পিপলস ফ্রিডম অ্যালায়েন্স (ইউপিএফএ) ও রাজাপক্ষের দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির মিলিত আসনের সংখ্যা ৯৫ এবং বিক্রমাসিংহের দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) আসনসংখ্যা ১০৬। তার মানে রাজাপক্ষে ও সিরিসেনার মোট আসনের চেয়ে এখনো সিরিসেনার ১১ আসন বেশি রয়েছে।

সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের দল জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছিল। বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করার আগে জোট থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে সিরিসেনার দল। বরখাস্ত হওয়ার আগে বিক্রমাসিংহে দিল্লির সহায়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দিল্লি তাঁকে বরখাস্ত হওয়া থেকে বাঁচানোর মতো কোনো সহায়তা দিতে পারেনি। এ অভ্যুত্থানের পেছনে আরও অনেক কারণ আছে। কিছু দৃশ্যমান এবং কিছু অদৃশ্যমান।

রাজাপক্ষে এর আগে যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন থেকেই তিনি চীন সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। চীনের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে একধরনের ফাঁদে পড়ে আছে। এই ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ার জন্য রাজাপক্ষেকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। এই ঋণ শোধ করতে না পারায় শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটা বন্দর চীনকে দিতে বাধ্য হয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে কলম্বোয় সার্বভৌমত্বের কিছু অংশ চীনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

চীন মালদ্বীপে যেভাবে রাজনৈতিক খেলা খেলছে, ঠিক এই খেলা তারা শ্রীলঙ্কায়ও শুরু করেছে। চীনের ইশারায় রাজাপক্ষের ফিরে আসাটা শ্রীলঙ্কার জন্য তো বটেই, ভারতের জন্যও তা একটি অশনিসংকেত। এর কারণ হলো চীন এ অঞ্চলে নব্য উপনিবেশবাদ গড়ে তুলতে চায় এবং রাজাপক্ষে ক্ষমতায় থাকলে সে লক্ষ্য পূরণ চীনের জন্য অনেক সোজা হয়ে যাবে। এ জায়গায় ভারতের অনেক শিক্ষণীয় আছে। এ ঘটনা থেকে ভারতকে আবারও বুঝতে হবে, চীন এ অঞ্চলের সমুদ্রসীমানায় তার আধিপত্য বিস্তারে যা যা করণীয়, তার সবই করবে। সি চিন পিং যত দিন ক্ষমতায় আছেন, তত দিন চীনের এই সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

 মালদ্বীপে চীন এক পা পিছিয়েছে বটে, কিন্তু শিগগিরই সে আবার সর্বশক্তি দিয়ে সেখানকার সরকারব্যবস্থায় তার প্রভাব বিস্তার করবে।

 কলম্বোয় রাজাপক্ষে সরকার চীনের প্রবল চাপের মুখে পড়বে। ভারতের সব ধরনের প্রভাব মুছে ফেলতে রাজাপক্ষে সরকারকে তারা ক্রমাগত চাপ দিতে থাকবে। যে রাজাপক্ষে সরকারকে তিন বছর আগে শ্রীলঙ্কার মানুষ ছুড়ে ফেলেছিল, সেই সরকার এখন তাদের কাঁধে চেপে বসছে। এটি তাদের মধ্যেও অস্থিরতা তৈরি করবে। রাজাপক্ষে সরকার ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গে চীনের সাবমেরিনের আনাগোনা শ্রীলঙ্কার উপকূলে বেড়ে যাবে এবং দেশটি থেকে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে থাকবে।

তবে তার আগে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করে সিরিসেনা যেভাবে রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়িয়েছেন এবং সেটা নিয়ে যে উত্তেজনা চলছে, তা শিগগিরই মিইয়ে যাবে, তা মনে হয় না। এটি নিয়ে জনগণের মনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা পর্দার আড়ালে থেকে চীন কতটুকু প্রশমিত করতে পারবে, সেটা দেখার বিষয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। ভারতের নিউজ নেশন পত্রিকা থেকে নেওয়া

কমলেন্দ্র কানওয়ার: ভারতীয় সাংবাদিক