গণতন্ত্রের গলদ দূর করা দরকার

ঢাকায় দায়িত্ব পালন করছেন এমন বিদেশি কূটনীতিকেরা বাঙালি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একটি মুখস্থ কথা বলেন: তাঁরা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও তাই চায়। যেসব দেশে কার্যকর গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানকার নির্বাচন সাধারণত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যই হয়ে থাকে। তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গলদ থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে না।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হতেই হবে। তবে শুধু নির্বাচনই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে না। সেটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ মাত্র। গণতান্ত্রিক সুশাসনের জন্য আরও অনেক জিনিস দরকার। বহুদলীয় গণতন্ত্রে নেতাদের অনেক দায়িত্ব। সভা-সমাবেশে বক্তৃতার বাইরে ঘরে বসে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে পর্যালোচনা করা, ক্ষমতায় গেলে বা না গেলে তাঁদের কী করণীয় তা জনগণকে অবগত করা নেতাদের অবশ্যকরণীয় কর্তব্য। নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামানোর সঙ্গে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সংস্কার করাও তাঁদের কাজ।

বাংলাদেশের সামগ্রিক শাসনব্যবস্থায় এমন এক জটের সৃষ্টি হয়েছে যে জট খোলা সুদক্ষ, দূরদর্শী ও ত্যাগী নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভব নয়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত না হলে নির্বাচন কমিশন হোক বা অন্য যেকোনো স্বাধীন সংস্থা হোক, জনগণ সেগুলো থেকে উপকৃত হবে না। কারচুপিমুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ও সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে না, যদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন না করে। বাংলাদেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটতে পারছে না। প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধান জানেন তাঁর মাথার ওপর একটি অদৃশ্য ছড়ি ঘুরছে। তাঁর দায় জনগণের কাছে নয়, তাঁর নিয়োগদাতা প্রভুর কাছে।

ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি ও কালোটাকার মালিককে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে এমন শক্তি বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষের নেই। তার ফলে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী ধনকুবেরের কাছে আজীবন নিবেদিত একজন সৎ রাজনৈতিক নেতার পরাজয় অবধারিত। ভোট যখন গোপন ব্যালটে হয়, তখন অনায়াসেই একজন দুর্নীতিবাজকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের ভোটারদের নৈতিক চেতনার মান সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে একজন বিত্তবান অসাধুকে তাঁরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত না হওয়ার বহু কারণ। নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের দায়ে নির্বাচন কমিশন কোনো প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা রাখে; কিন্তু তাদের সে মুরোদ আছে কি না, তা মানুষ জানে না। প্রদত্ত ক্ষমতা এক জিনিস আর ক্ষমতা প্রয়োগের মুরোদ আরেক জিনিস। তার জন্য চেয়ারে বসা ব্যক্তিবিশেষের শক্ত মেরুদণ্ড চাই।

নির্বাচনের সময় আইন লঙ্ঘন দুদিক থেকেই হতে পারে। বিরোধী দলের আইন লঙ্ঘনকারীদের পাকড়াও করা যত সহজ, ক্ষমতাসীন দলের আইন লঙ্ঘনকারীদের কেশাগ্র স্পর্শ করা ততটাই কঠিন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী আইন ও বিধি লঙ্ঘন আমাদের দেশে খুব বেশি হয়। আইন অমান্যকারীদের হাজতে পাঠানোর মতো বুকের পাটা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের আছে সে প্রমাণ জনগণ পায়নি। প্রভাবশালী হলে যা কিছু করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথে বড় বাধা।

আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গলদ অনেক রকম। সব গণতন্ত্রেই নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে এলাকার জনগণ জানেই না যে কোন দলের কে তাদের সাংসদ পদপ্রার্থী। গত তিন-চারটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা হয়েছে, প্রার্থী মনোনয়নে প্রধান দলগুলো স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দেয়। প্রার্থী মনোনয়নে এলাকার জনগণের মতামতের দুপয়সা দাম নেই। মনোনয়ন–বাণিজ্য বলে এখন একটা কথা প্রচলিত। যার যত টাকা, মনোনয়ন পাওয়ার সৌভাগ্য তার তত বেশি।

বড় দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়নের পদ্ধতি উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সহায়ক নয়। তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। প্রার্থীর নাম ঘোষণার আগের দিনও এলাকার মানুষ তো নয়ই, দলের নেতারাও জানেন না কে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। এলাকায় দলের নিবেদিত নেতারা নন, হঠাৎ অনেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেন। হয়তো একদিন তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ওই এলাকায় ছিল। সেখানে দোচালা বা চারচালা টিনের ঘর ছিল। আশির দশক থেকে তিনি রাজধানীবাসী। এখন ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারার বাসিন্দা। প্রকাণ্ড ব্যবসায়ী। ডেমরা, আশুলিয়া, গাজীপুরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা বাগানবাড়ি। এলাকার ৬০ বছরের কম বয়সী মানুষ তাঁকে চেনে না। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে লুঙ্গি, শাড়ি, জায়নামাজ নিয়ে পাজেরো হাঁকিয়ে এলাকায় যাবেন। সামনে–পেছনে শ খানেক মোটরসাইকেল। মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুলে মোটা চাঁদা দেবেন। নির্বাচনের দিন মানুষ ভোট দেবে প্রার্থীকে নয়, প্রার্থীর প্রতীককে। নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে দেখা যাবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির তোয়ালে দেওয়া চেয়ারে উপবিষ্ট। কখনো এলাকার কোনো অনুষ্ঠানে যদি তাঁকে প্রধান অতিথি করা না হয়, সেই অনুষ্ঠানের চেয়ার, টেবিল, মাইক্রোফোন অক্ষত থাকবে—সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে উঠতে পারেনি নানা কারণে। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়ার পথে বিচিত্র বাধা। একদিন এ দেশে সামন্ততন্ত্র ছিল। জমিদার ও জমিদারের ছেলেমেয়েরাই ছিলেন তাঁদের এলাকার প্রভু। গণতন্ত্রের যুগে নতুন সামন্ততন্ত্র শুরু হয়েছে পরিবারতন্ত্রের প্রথার মাধ্যমে। আগে ছিল জমিদারের পরিবার, এখন নেতার পরিবার।

রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের কথা বলা হয় জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে যে পরিবারতান্ত্রিক কুপ্রথার সৃষ্টি হয়েছে যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী। বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে  পরিবারতন্ত্রের অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের হাতে আছে। এই পরিবারতান্ত্রিক প্রথার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের দুটি বড় শাসক দল। তাদের দলের কোনো সাংসদ মারা গেলে উপনির্বাচনে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্ত্রী, পুত্র বা কন্যাকে ওই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। যাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হয় তাঁদের যোগ্যতা থাক বা না থাক। ওই আসনে দলের আর কেউ যদি প্রার্থী হওয়ার স্পর্ধা দেখান, তবে তাঁর বিপদের শেষ নেই। তার ফলে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।

ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের তো কোনো মূল্যই নেই। নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুও হয়, কিন্তু গণতন্ত্র চর্চায় যদি থাকে গলদ, তাহলে জনগণের ও জাতির কোনো লাভ নেই। জনগণের মতামত উপেক্ষা করে কোনো গণতন্ত্র হয় না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনী প্রচারণা জোরসে চলছে। বিভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে পত্রপত্রিকা সচিত্র প্রতিবেদন করছে। কোনো দল থেকেই প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়নি। তবে এ কথা
বলে ধমক দেওয়া হচ্ছে যে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তার রেহাই নেই। আবার এ কথাও বলা হচ্ছে ডামি প্রার্থী দেওয়া হতে পারে, যদি প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে না আসে।

রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় তারা রয়েছে অন্ধকারে ও হতাশায়। কোনো এলাকার কোনো দলের প্রার্থীর নাম অনানুষ্ঠানিকভাবেও যদি বছরখানেক আগে ঘোষণা করা হয়, তাহলে ভোটাররা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও যোগ্যতা বিচার করে দেখার সময় পান। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। রাজনৈতিক দলের ভেতরেই যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে জনগণের শাসন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠার আশা দুরাশা। সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির গলদ দূর করার জন্যও গণতন্ত্রকামী নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক