সংলাপে জয়ী হোক জনগণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও  ড. কামাল হোসেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. কামাল হোসেন

বাংলাদেশ রাজনীতিতে সংলাপ হতে যাচ্ছে—এটাই একটি সুখবর। সব সময় এমন সংলাপকে স্বাগত জানানো হয়। যদিও কোনো সংলাপ থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সমাধান আসেনি। রাজনীতির মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো কোনো নজির তৈরি হয়নি। তারপরও সংলাপ আর স্বাগত সব পরিস্থিতিকে আমরা সমার্থক ধরে নেব।

কারণ, অনির্দিষ্টকাল ধরে মুলতবি হয়ে যাওয়া সংলাপেরও একটা ইতিবাচক রেশ থাকতে পারে। কিন্তু এটা নির্ভর করছে উভয় দল কীভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখে, তার ওপর।

২০০৬ ও ২০১৩ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তৎকালীন দুই সাধারণ সম্পাদক এবং মহাসচিবের নেতৃত্বে নির্বাচনবিষয়ক সংলাপ হয়েছিল। নির্বাচন বিষয় ছাড়া বাংলাদেশে কখনো সংলাপ হয় না। সেই ধারা এবারেও চলমান। এটা কাটানোর কথা ভাবা যায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সরকারপ্রধান দেশের বিরোধীদলীয় জোটের সঙ্গে নির্বাচন বা রাজনৈতিক সংকট প্রশ্নে গণভবনে নৈশভোজে মিলিত হচ্ছেন।

এটা লক্ষণীয়, আসন্ন সংলাপে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাউন্টার পার্ট থাকবেন বঙ্গবন্ধুর আপনজন ড. কামাল হোসেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অনুসারী আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের উপস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় রাজনীতিতে এটা নতুন অগ্রগতি এবং এর একটা তাৎপর্য আছে।

আনুষ্ঠানিক কোনো রাজনৈতিক সংলাপ অতীতে সফল হয়নি। তবে মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকা এবং পরস্পরের প্রতি মন্তব্যে সৌজন্য ও বিনয়ের বেশ ঘাটতি থাকার মধ্যে এই সংলাপ হচ্ছে। এই সংলাপ সফল হলে বাংলাদেশ উৎসবে ভাসবে। ব্যর্থ হলে হতাশা দেখা দেবে। তবে মাঝামাঝি একটা কিছুর জন্য প্রার্থনা করি। তত্ত্বগতভাবে, উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে সংলাপ যথেষ্ট সফল হওয়ার সুযোগ সীমিত। এটা বিবেচনায় উভয় পক্ষ যেন এটুকু মনে রাখে, এই সংলাপ সর্বাঙ্গীণ সার্থক না হলেও তা যেন নতুন করে অধিকতর দূরত্ব বা চাপান–উতোরের মওকা তৈরি না করে। যে অচলাবস্থা বিরাজমান, তা যেন আরও অবনতিশীল না হয়।

উভয় পক্ষের কাছে প্রত্যাশা সংলাপের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা। একটি–দুটি বৈঠকেই সবকিছু চুকেবুকে না যায়। এমনকি আগামী ১ নভেম্বরের প্রথম বৈঠকে দুই তরফে দুটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠনেও আলোচনা হতে পারে। কারণ, কোনো বিষয়ে সমঝোতার জন্য খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ে সময়সাপেক্ষ আলাপ-আলোচনার দরকার হতে পারে।

বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠিতে উল্লেখ আছে, ‘সংবিধানসম্মত সব বিষয়ে আলোচনার দ্বার সর্বদা খোলা আছে।’ এটা নির্বাচন নয়, আরও অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংলাপের দুয়ার খোলার পথ প্রশস্ত করেছে। এ দেশে আমরা বলি বটে সংলাপ কখনো সফল হয়নি, তার একটা কারণ এই যে আমরা অভ্যাগতভাবে মেনে নিয়েছি, নির্বাচন বা ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় ছাড়া আর সংলাপ হতে পারে না। এটা তো একটি জাতির জীবনে চলতে পারে না।

১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন প্রশ্নেই কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয়েছিল মাত্র। তাঁরা সংলাপে বসেননি। স্যার নিনিয়ান স্টিফেন এবং জিমি কার্টারের মধ্যস্থতা বা সম্প্রতি জাতিসংঘ দূতের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

নির্বাচনকালীন গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনে সংবিধানসম্মত একাধিক বিকল্প আছে। ঐক্যফ্রন্টের উচিত হবে প্রথম দিনের সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর চিঠির সূত্রেই প্রস্তাব রাখা যে তারা আসন্ন নির্বাচনকে অর্থবহ করতে সংবিধানের আওতায় একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দিতে চায়। সেই জন্য একটি লিয়াজোঁ কমিটি হোক। এই লিয়াজোঁ কমিটির পরিসর আরও প্রতিনিধিত্বশীল করার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

আসলে এটা চাইছি যে সংলাপ প্রচলিত অর্থে অর্থবহ হবে কি না, তার থেকে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিকেরা যে ঘন ঘন বা একটা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা চালাতে পারেন, তার একটা নজির তৈরি করা কম দামি নয়। এবারের সংলাপের নানা মাত্রা আছে। একটি প্রধান দলের শীর্ষ নেতা দণ্ডিত হওয়ার পরে প্রতিবাদে হরতালের মতো কিছু হচ্ছে না, এটা অভাবনীয় ছিল, এখন সংলাপ হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা বিরাট ব্যতিক্রম। কিন্তু তা জাতীয় রাজনীতিতে মৌলিক গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ কি না, সেটা বিচার্য।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সতর্ক মন্তব্য করেছেন, আপিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধির ফলে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এখন সারা দেশে একটা স্বস্তির বাতাস বইবে যদি এই সংলাপ ফলপ্রসূ ও অর্থবহ হয়। আমরা সর্বতোভাবে সংলাপের সাফল্য কামনা করি। কারণ, এই সংলাপের ওপর বহুলাংশে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের গুণগত মান এবং গ্রহণযোগ্যতার একটা প্রশ্ন সরাসরি জড়িত রয়েছে।

ঐক্যফ্রন্টের দেওয়া সাত দফাভিত্তিক সংলাপ প্রস্তাব ক্ষমতাসীন দল নাকচ করে দেওয়ার পরপরই আবার তা গ্রহণ করেছে। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করাই বাংলাদেশ রাজনীতির জন্য বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। আর এই নির্বাচন শতভাগ অংশগ্রহণমূলক হবে, তা এখন পর্যন্ত হলফ করে বলা যায় না। প্রাক্‌–নির্বাচনী অনুকূল পরিবেশ কতটা কী শক্তিশালী রূপ নেয়, তার ওপর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনী হাওয়ার গতিপ্রকৃতি অনেকটাই নির্ভর করছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, তার ওপর একাদশ সংসদের প্রকৃত বৈধতার প্রশ্নও জড়িত থাকবে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগকে কার্যত স্বীকার করতে হয়েছিল যে তারা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন দিয়ে পাঁচ বছর চালাবে না, নতুন নির্বাচন দেবে। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে তারা পাঁচ বছরের মেয়াদ পার করতে পেরেছে। কিন্তু এতে তাদের গৌরব বেড়েছে কিংবা জনগণের মন থেকে সব প্রশ্ন মুছে গেছে, সেটা ধরে নেওয়ার কারণ নেই। একতরফা নির্বাচন একবার ঘটেছে বলে আওয়ামী লীগ তার অবিকল পুনরাবৃত্তি আশা করতে পারে না।

সংগত কারণেই আওয়ামী লীগ দুটি পথই খোলা রেখেছে। তারা বলছে, নির্বাচন তারা বিএনপিকে নিয়েই করতে প্রস্তুত। আবার মেয়াদ শেষে নির্বাচন একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কোনো দল এল বা এল না, সে জন্য অপেক্ষা করা যাবে না।

অন্যদিকে, ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ভুল করেছিল বলে একটা উপলব্ধি বিএনপির মধ্যেও আছে। আবার তাদের দলের ভেতরে এর বিপরীত মতও কম জোরালো নয়। আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে তারা কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে গেছে। বাংলাদেশ রাজনীতিতে এটাও একটা নতুন অগ্রগতি। অবশ্য এর ফলে রাজনৈতিক দর-কষাকষির ক্ষমতা নানা প্রতিকূলতা ও ব্যর্থতায় জেরবার বিএনপির কতটা বেড়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের কিছুটা সমালোচনা করেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে নীতিগতভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। এরপর ঐক্যফ্রন্টের তরফে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব মুক্তিসংগ্রামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিও একটি ভালো অগ্রগতি বলে আমরা মনে করি। এতে যথার্থই সংবিধানের প্রস্তাবনায় থাকা গণতন্ত্রসংক্রান্ত অঙ্গীকার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে কামাল হোসেনের স্বকীয়তার ছাপ আছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা যে এই দৃষ্টিভঙ্গি মেনেছে, ক্ষমতাসীন দলকে এটাও একটা অগ্রগতি হিসেবে দেখতে হবে। এবং যার যতটুকু প্রাপ্য তা তাকে যে দিতেই হবে, সেটাও তাদের বিবেচনায় নিতে হবে।

আমরা মনে করি, সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন এবং সরকার ও সংসদ সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করতে হলে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ন্যূনতম রাজনৈতিক সংহতি ও বোঝাপড়ার দরকার। এই ঘাটতি নিরসনে কোনো ধরনের চেষ্টা না করা ভালো নয়।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও জাতীয় রাজনীতিতে এই ঘাটতি প্রকট থাকার কারণেই আমরা পদে পদে হোঁচট খাচ্ছি। সংলাপকে যাতে কোনো দলই কৌশলগত হিসেবে না দেখে। একটা অচলাবস্থা চলছে, শান্তকামী মানুষ এর অবসান চায়। তারা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে চায়। তবে এটা স্বতঃসিদ্ধ যে সংলাপ ও প্রাক্‌–নির্বাচনী পরিবেশ উন্নত করতে সরকারের দায়িত্ব বেশি।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]

অারও পড়ুন :