শ্রমিকই কি আসল খলনায়ক?

অনেকের চোখে শ্রমিকেরা এখন খলনায়ক। তাঁরা বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে বেশুমার মানুষ মারবেন, অথচ বিচারে তাঁদের ‘গ্রেসমার্ক’ দিতে হবে, মামলা সর্বদাই ‘জামিনযোগ্য’ই হবে! কেন তাঁরা মাফিয়া নেতাদের কথায় ওঠবস করেন, জনস্বার্থের বিপক্ষে ধর্মঘট করেন? প্রশ্নগুলো খুবই যৌক্তিক। এর অন্য দিকও আছে। পরিবহন ধর্মঘটে যাঁদের মুখে কালি মাখানো হয়েছে, তাঁদের ৯৯ ভাগই কিন্তু পরিবহনশ্রমিক। এর পাঁচ দিন আগে, বৃহস্পতিবার ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু টোলমুক্ত করার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মৃত সোহেল (২৮) আর আহত ১০ জনও শ্রমিক। তাহলে কোন শ্রমিক ‘আসল’ শ্রমিক?

এক কথায় জবাব হয় না। কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতায় বলেছিলেন মার্ক্সের শ্রমিকতত্ত্বের মূলকথা:

অনেক শ্রমিক আছে এইখানে।

আরো ঢের লোক আছে

সঠিক শ্রমিক নয় তারা।

স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝ’রে

এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে। (এইসব দিনবাত্রি)

 যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক। যিনি তাঁর দুরবস্থার জন্য দায়ীদের হাতের পুতুল হন, তিনিও শ্রমিক। তবে তাঁর শ্রমের ফল তিনি ভোগ করেন না, করেন অন্যজনা। ভালো শ্রমিকও তাঁর শ্রমের তুলনায় কম বেতন পান, খারাপ শ্রমিকও তা-ই। মার্ক্সের একটা বিতর্কিত কথা ছিল, কৃষকেরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না, ওপরতলার লোকেরা তাঁদের নেতা হন। যেখানে নাগরিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নেই, সেখানে প্রতিনিধিত্বের দরজা কেবল প্রভুদের জন্যই খোলা। বাংলাদেশে সব রকম জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ প্রায় শেষ। জনগণের কোনো অংশই নিজেরা আর নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না—সেটা পেশাজীবী সংগঠনই হোক আর সংসদই হোক। এমন দশায় শ্রমিকেরা তাঁদের শ্রেণিশত্রুর হাতে জিম্মি হবেন।

কিন্তু যে শ্রমিক আন্দোলন গত শতকের ত্রিশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত জাতীয় অর্জনের অন্যতম নায়ক, তাঁরা কেন কালি হাতে খলনায়কের পঙ্গপাল হলেন? শোষিত শ্রমিকেরা কেন শোষকের কথায় চলেন, অথচ এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁরা ছিলেন সামনের সারির লড়াকু। স্বৈরাচার তখন রাষ্ট্র হাতে নিয়ে থাকলেও সমাজকে নিস্তেজ করতে পারেনি বলে গণসংগঠনগুলো সক্রিয় ছিল। তারপর নব্বইয়ে গণতন্ত্র এল মুক্ত বাজারের অবাধ লুটপাটের সঙ্গী হয়ে। সমাজ ভেঙে গেল, শিল্পায়ন না হয়ে শ্রম খাতের মালিকানা ও মুনাফার মাফিয়াকরণ ঘটল। গণসংগঠনগুলো নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে পারল না, শ্রমিকদরদি সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব ছিনতাই হলো। বহু নিষ্ঠাবান শ্রমিকনেতা বরখাস্ত কিংবা বন্দী, এমনকি নিহত হলেন। অনেক বাম নেতা মালিকপক্ষে ডিগবাজি দিয়ে হলেন কামিয়াব। শ্রমিকের নিজস্ব সংগঠন গড়ায় বাধা সৃষ্টি করল রাষ্ট্র আর মালিকেরা পকেটে পুরলেন তাঁদের সংগঠনগুলো। শ্রমিক রাজনীতির উল্টোযাত্রা রাজনৈতিক অর্থনীতির উল্টো বিবর্তনের হিসাব মেনেই চলেছে।

শ্রমিক-কৃষকের মতো অসহায় কেউ নেই আজ। তাঁরা হলেন নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক। কারখানায় সুষ্ঠু কাজ নেই, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। ওদিকে পরিবহন খাতে যত বেশি মাফিয়া সিন্ডিকেট হয়েছে, তত সেখানে মজুরি ও অধিকার কমেছে। শ্রমিক যত অসহায় হয়েছেন, ততই মালিকের কৃপাজীবী হয়েছেন। তাঁদের অনেকেরই মজুরি নেই, দৈনিক মালিক নির্ধারিত টাকায় গাড়ি ভাড়া নেন তাঁরা, তারপর রাজপথের নৈরাজ্যের মধ্যে ছোটাছুটি করে সেই টাকাটা তুলতে মরিয়া হন। তাঁর ট্রিপ, তাঁর থানার গ্যাঞ্জাম, তাঁর নিরাপত্তা মালিক দেখেন। মাফিয়াতন্ত্র চাকরির মালিক, বৈধ-অবৈধ সুযোগ বাঁটোয়ারা করার মালিক। এভাবে মালিকেরা ব্যবসার সম্পূর্ণ ঝুঁকিটা ঠেলে দিয়েছেন শ্রমিকের ওপর। শ্রমিক মালিক-পুলিশকে তোয়াজ করে চড়াও হচ্ছেন যাত্রীদের ওপর। আট ঘণ্টার শ্রম দিবসের দাবির কথা ভুলে তাঁরা তখন নামেন ‘দুর্ঘটনার’ দায়ে ফাঁসি থেকে বাঁচতে। কাউকে অমানবিকভাবে শোষণ করা মানে তাঁর মানবিকতাটাও কেড়ে নেওয়া হয়। শ্রমিকের পরিণতি হলো এই। তখনই ধর্মঘটে অ্যাম্বুলেন্স আটকিয়ে তাঁরা মাসুম বাচ্চার পরোক্ষ ঘাতক হন, তাঁদের নেতা তখনো হাসেন

মালিক ও নেতা তাঁদের মুরব্বি আর শ্রমিক উমেদার। এই প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট রিলেশনেই রাজনীতি ও অর্থনীতি চলে আমাদের। মধ্যবিত্ত-শিক্ষিতদের অনেকেও কি ক্ষমতাবানদের উমেদারি করেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্ষমতাসীন নেতাদের ভয়ও পান আবার তাঁদের কৃপাতেই হলে সিট পান। যেখানে চাকরি-মজুরি-নিরাপত্তার অধিকার রাজতন্ত্রের মতো রাজকীয় লোকজনের দয়ার ওপর নির্ভর করে, যেখানে সবাই জেনে গেছে যে জোর যার মুল্লুক তার, সেখানে শ্রমিকের মধ্যে বিপ্লবী চরিত্র খোঁজা বাতুলতা। নাগরিক হিসেবে অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত না হলে শ্রমিক নিজস্ব স্বার্থে কাজ করতে পারেন না। ন্যায্য পাওনা ওপরতলার দয়ামায়ার ওপর ছেড়ে রাখলে, আমরা স্বাধীন মানবিক নাগরিক আশা করতে পারি না।

তাহলে আমাদেরই—যাঁরা মধ্যশ্রেণির লোক বা তারও ওপরের—তাঁদেরই বরং নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, আমাদের নীতিকথা বনাম মাফিয়া নেতার করুণা, কোনটা মানবেন তাঁরা? আমরা যা দেখছি, তা শ্রমিক রাজনীতিও না, যা ছিল আশির দশকে; এটা শ্রেণিসংগ্রামও না, যা ছিল ষাটের দশকে—এটা পরিষ্কারভাবে মালিকপক্ষীয় তাঁবেদারির রাজনীতি, যে মালিকপক্ষ আসলে আওয়ামী লীগেরই লোকজন

যখন শ্রমিক ও জনতা কেউ কাউকে চেনে না, তখন খেলা চলবে কে কার কাছ থেকে কতটা আদায় করতে পারে তার ভিত্তিতে। শ্রমিকেরা তখনই সবার স্বার্থের কথা মানবেন, যখন সকলে তাঁদের স্বার্থের কথাটাও মনে রাখবে। সড়ক ব্যবস্থাপনা ঠিক না করে, মালিকদের শোষণ না কমিয়ে, নিরাপদ গাড়ি চালানো লাভজনক না করে যে মালিকপক্ষ শ্রমিক ও যাত্রীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগানোর ধর্মঘট উসকাল, তাঁদের শাস্তি না চেয়ে কেবল শ্রমিককে ভিলেন ভাবলে তাঁরা আরও বড় ভিলেনকে আঁকড়ে ধরবেন। খেয়াল করুন, ধর্মঘটের সাত দফা দাবিতে কোথাও উপযুক্ত মজুরি বা নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবি নেই। সেদিকে না তাকিয়ে শ্রমিকের মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হলে চরম ঝুঁকিতে রাস্তায় নামা লোকটি দুর্ঘটনার ভয়ের চেয়ে বেশি ভয় পাবেন জেল-ফাঁসিকে।  

এভাবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চলে কেবল শ্রমিক বনাম জনতা হিসেবেই নয়, শ্রমিক দিয়ে শ্রমিক ঠকানোর কায়দায়ও ওটা। তাঁদের সামনে যখন রাষ্ট্র-সরকার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দেয় না, সমাজের আরেকটু ওপরের লোক সহানুভূতি কম বোধ করেন, তখন তাঁদের কাছ থেকে মানবিকতা, আত্মত্যাগ আশা করা যায় কি? শ্রমিকদের অবশ্যই দায়িত্বশীল ও মানবিক হতে হবে, তার জন্য সরকার-রাষ্ট্র-মালিকদেরও দায়িত্বশীল ও মানবিক করা চাই। যে মাফিয়াতন্ত্রের হাতে জনস্বার্থ জিম্মি, শ্রমিকেরা সেই মাফিয়াতন্ত্রের নিকটতম শিকার। এই বোঝাবুঝি থেকেই শ্রমিক-জনতার সম্পর্ক নতুন করে দাঁড় করানো হয়তো সম্ভব।

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক