আল্লাহ করবে তোমার বিচার

ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফোরামে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। রিয়াদ, সৌদি আরব, ২৪ অক্টোবর। ছবি: রয়টার্স
ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফোরামে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। রিয়াদ, সৌদি আরব, ২৪ অক্টোবর। ছবি: রয়টার্স

ট্রাম্প সাহেব ‘ভালা’ মানুষ। পেটে ‘কাতুকুতু’ দিলেও বন্ধুর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেন না। কিন্তু সময় প্রতিকূল। ঘটনা সত্য, সাক্ষীও শক্ত। তাই বুক ফেটে গেলেও একপর্যায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মুখ ফুটে বলতে বাধ্য হন, সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতেই হয়, তাহলে তিনি সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

সৌদির বাদশাহ ও যুবরাজের ওপর ট্রাম্পের অগাধ বিশ্বাস। তাই খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে শুরু থেকেই রিয়াদ যা বলে আসছে, তার ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থান অনেকটা ‘সহমত ভাই’। ‘রহস্যজনক’ হত্যাকাণ্ডটি তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে ঘটলেও তার আদ্যোপান্ত খবর এখন হোয়াইট হাউসেও আছে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। ওই যে—নাম বললে ব্যবসা থাকবে না।

ট্রাম্পের বলার ভঙ্গিই বলে দেয়, গলায় হাড় বিঁধেছে। আর ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’। তাই গায়ে পানি না লাগিয়ে দায়সারাভাবে ট্রাম্প তাঁর দায়িত্ব সেরেছেন। একটু না শাসালে বিশ্ব মুরব্বির ‘মানসম্মান’ কি আর থাকে! দোষ প্রমাণিত হলে সৌদি আরবকে কঠিন সাজার হুমকি দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। খাসোগি খুনে সৌদি আরব স্বীকারোক্তি দেওয়ার পরও প্রমাণের অপেক্ষায় আছেন মিস্টার প্রেসিডেন্ট।

ক্ষমতার কাছে দুনিয়াটা বড় অসহায়রে পাগলা। ক্ষমতাবানেরা দেদার অপকর্ম করে। কিন্তু দায় তাদের নিতে হয় না। বলির পাঁঠা আছে না? যুগে যুগে কালে কালে পাঁঠারা বলি হয়ে আসছে। খাসোগি খুনের ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটতে যাচ্ছে। এই খুনের গডফাদার কে, তা এত দিনে পুরো বিশ্ব জেনে গেছে। কিন্তু ভাশুরের নাম কেউ মুখে আনছে না। সবাই ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে চলছে।

সৌদি আরবের বাদশা সালমান। রয়টার্স ফাইল ছবি
সৌদি আরবের বাদশা সালমান। রয়টার্স ফাইল ছবি

তুরস্কের কথাই যদি ধরি, তারা শুরু থেকেই বলে আসছে, খাসোগি হত্যার সব প্রমাণ তাদের কাছে আছে। কিন্তু সেই প্রমাণ তারা এখন পর্যন্ত ‘পাবলিক’ করেনি। তারা বারবার বল ঠেলে দিচ্ছে সৌদির কোর্টে। বোঝাই যাচ্ছে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান পাকা জুয়াড়ির মতো জুয়া খেলছেন। খাসোগি হত্যার রহস্য উন্মোচনের চেয়ে সৌদিকে মাইনকার চিপায় ফেলে স্বার্থ উদ্ধারের ধান্দা এখানে প্রবল। তলেতলে অনেক মিটিং-সিটিং ও দেনদরবার চলছে। দিন যত যাচ্ছে, এরদোয়ানের গলা তত নিচু হচ্ছে।

ক্ষমতাধর আরেক বড় ভাই ভ্লাদিমির পুতিন এসব উটকো ঝই-ঝামেলার মধ্যেই নেই। খাসোগির মতো ‘অবাধ্য’ অনেক সাংবাদিকই তাঁর দেখা আছে। তাঁদের ঠান্ডাও করা হয়েছে। সুতরাং এই ইস্যুতে ক্রেমলিনের অবস্থান ‘নো টক’। দুই টাকার সাংবাদিক খাসোগির পক্ষে কথা বলে সালমান গংদের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করার মতো বোকা লোক পুতিন নন।

সৌদি আরবের কথা আর কী বলব! মিথ্যা কত প্রকার ও কী কী, তা উদাহরণসহ তারা শেখাচ্ছে। প্রথমে তারা বলল, না, জলজ্যান্ত খাসোগি হেঁটে হেঁটে সৌদি কনস্যুলেট ত্যাগ করেছেন। এই দাবি প্রমাণে খাসোগির ডামিও সাজানো হয়েছে। নিরুপায় হয়ে তারা আরেক মিথ্যার আশ্রয় নেয়। খাসোগি নাকি হাতাহাতিতে নিহত হয়েছেন! কাঁচা মিথ্যায় জুত করতে না পেরে তারপর তারা বলল, খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে। এখন রিয়াদ আমতা-আমতা করে স্বীকার করেছে, খাসোগি হত্যা পূর্বপরিকল্পিত।

খুব ভালো কথা। তো সেই পূর্বপরিকল্পনাটা কে করেছেন, তাও নিশ্চয়ই সৌদি আরবের জানা আছে। কিন্তু সৌদি আরব প্রকৃত সত্য উন্মোচন করে খুনের নির্দেশদাতা থেকে শুরু করে ঘাতক দলের সবাইকে শাস্তি দেবে বলে রিয়াদের হাবেভাবে মোটেও মনে হয় না।

খাসোগি হত্যার ঘটনায় ১৮ জন সৌদি নাগরিককে গ্রেপ্তার এবং পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে ট্রাম্পের ভাষায় সৌদি আরব ‘চমৎকার’ পদক্ষেপ নিয়েছে। বহিষ্কার হওয়া পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্যে যুবরাজ সালমানের ডান হাতও আছেন। অথচ খুনের সঙ্গে জড়িত সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা পুনর্গঠনের প্রধান করা হয়েছে সেই যুবরাজকেই।

কী হাস্যকর, কী তামশা! যিনি খাসোগি হত্যার সন্দেহভাজন নির্দেশদাতা, সেই যুবরাজ সালমানই এই ঘটনার তদন্তকারী। এই তিনিই আবার ন্যায়বিচারের বুলি দিচ্ছেন। লোকজনকে দেখাতে হয়তো সৌদি আরব খাসোগি হত্যার বিচার করতে। কিন্তু সবাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে সে ক্ষেত্রে তলোয়ারের কোপে কোনো না কোনো পাঁঠারই মাথা যাবে।

সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগি। রয়টার্স ফাইল ছবি
সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগি। রয়টার্স ফাইল ছবি

খাসোগি হত্যার পর খোদ সৌদি আরবেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, মোহাম্মদ বিন সালমানের যুবরাজের পোস্ট চলে যেতে পারে। কিন্তু কোথায় কী? বাপ-ছেলের লাইন এক। বাদশাহর আশকারা পাওয়া যুবরাজকে ফের উজ্জীবিত দেখাচ্ছে।

ভালো সাজতে বাদশাহ সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান খাসোগির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু ওই সাক্ষাতের সময় বাপ-পুতের চোখেমুখে শোকের ‘শ’-ও ছিল না।

সৌদি নেতৃত্ব যতই সাধু সাজার চেষ্টা করুক না কেন, তাদের মুখোশ আগেই খুলে গেছে। ইয়েমেনে হাজারো নিরপরাধ মানুষ সৌদির বোমায় প্রাণ হারাচ্ছে। দেশটিতে রক্তগঙ্গা বইছে। কিন্তু তারা নির্বিকার। যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ চলছে। শিশুদের হাড্ডিসার সব ছবি গণমাধ্যমে আসছে। আর এই যুদ্ধের কমান্ডার ইন চিফ যুবরাজ সালমান মিটিমিটি হাসছেন।

খাসোগির ছেলের ভাগ্য ভালো। তিনি অন্তত প্রাণটা নিয়ে সৌদি আরব ছাড়তে পেরেছেন। এতেই তাঁর শোকর করা উচিত। বাবার খুনের ঘটনায় ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা তিনি ছেড়ে দিতে পারেন। তাঁকে বুঝতে হবে, ক্ষমতা, তেল আর পেট্রডলারের কাছে নীতিনৈতিকতা, মানবিকতা ও ন্যায়বিচারের ফুটো পয়সারও দাম নেই। তবে হ্যাঁ, একজন তো নিশ্চয়ই আছেন। তাঁর কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া খাসোগি পরিবারের আপাতত আর কিছু করার নেই।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]