এ আগুন ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

ঝিনাইদহের মহেশপুর ইউনিয়নের মহেশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবে শিক্ষার্থীদের কোডিং শেখা চলছে। ছবি: সংগৃহীত
ঝিনাইদহের মহেশপুর ইউনিয়নের মহেশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবে শিক্ষার্থীদের কোডিং শেখা চলছে। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের একদল স্বেচ্ছাসেবক পাবনা জেলার ভাঙ্গুরা উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে গেছে। ঢাকা থেকে সারা রাত ট্রেনে করে ভোরে তারা সেখানে গেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার খবর পৌঁছে দিতে। তো সেখানকার খুদে প্রোগ্রামাররা আর তাদের ছাড়ে না। কথা ছিল দুপুরের পর তারা ভাঙ্গুরা থেকে রওনা হয়ে চলে যাবে বাগেরহাটে। কিন্তু তা হলো না। কারণ, স্কুলের মেয়েরা তাদের আটকে রাখল সন্ধ্যা পর্যন্ত, তাদের অনেক প্রশ্ন। এলাকার একমাত্র ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে কেমন করে তারা প্রোগ্রামিং শিখবে, কেমন করে এগিয়ে যাবে। ফলাফল হলো, স্কুল কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়িতে স্বেচ্ছাসেবকদের রাত কাটানো। 

পরদিন আবার যাত্রা। ভাঙ্গুরা থেকে ট্রেনে খুলনা। সেখান থেকে অটোরিকশায় রূপসা ঘাট। ট্রলারে নদী পার হয়ে আবার অটোরিকশায় বাগেরহাট। আমাদের মেন্টরদের দল বাগেরহাটে পৌঁছেছে সে খবর পেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বাগেরহাটের ফুলহাতা ইউনিয়নের ফুলহাতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র। তার দাবি, ওই মেন্টরগ্রুপকে যেতে হবে তাদের স্কুলে। কারণ, প্রত্যন্ত গ্রামের ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। কাজেই মেন্টরদের যাত্রাবিরতি। পরদিন আবার গাড়ি আর ট্রলার দিয়ে নদী পার হয়ে ফুলহাতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছেছে মেন্টররা। এ শুধু একটি মেন্টর দলের কয়েক দিনের যাত্রার বিবরণী। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএনের) মেন্টরদের এ রকম কয়েকটা দল এক মাস ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। উদ্দেশ্য প্রোগ্রামিংয়ের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। কখনো বাসে, কখনো ট্রেনে, কখনো নৌকা বা ট্রলারে চড়ে তারা গেছে ৬০টি স্কুল, কলেজের প্রায় ১৮ হাজার ছেলেমেয়ের কাজে। বলে এসেছে স্টিভ জবসের সেই বিখ্যাত বাণী—সবারই প্রোগ্রামিং শেখা দরকার। তবে সেটা এ জন্য নয় যে সবাই প্রোগ্রামার হবে। বরং এ জন্য, কোডিং শেখা দরকার। কারণ তা সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে তোলে।

আর তাই এখন বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে স্কুল পর্যায় থেকে প্রোগ্রামিং বা কোডিং শেখানোর প্রচেষ্টা। আরও একটি কারণ আছে। কারণটি হলো, ২০২০ সালে বিশ্বে ১০ লাখ কম্পিউটার প্রোগ্রামারের পদ খালি থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, সেই সব পদে কাজ করার মতো যোগ্য কর্মী পাওয়া যাবে না। গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল, মাইক্রোসফট—সবাই মিলে তাই বিশ্বজুড়ে এক নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে। আমরা কি পিছিয়ে থাকব?

নিশ্চয় না। আর তাই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এখন তথ্যপ্রযুক্তির পাঠ নিতে হয় শিক্ষার্থীদের। আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক–প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা তাদের জন্য তৈরি করেছে দলগতভাবে সমস্যা সমাধানের প্ল্যাটফর্ম, যার মূলমন্ত্র—কোড ভাঙ্গা জবাব দাও।

এখন দুনিয়া হচ্ছে ইন্টারনেটের দুনিয়া। এখানে এ ফর অ্যাপল, বি ফর বেটা আর সি ফর সি প্লাস প্লাস! অনেকেরই ধারণা, প্রোগ্রামিং বা কোডিং মনে হয় যারা শুধু প্রোগ্রামার হবে তাদের জন্য। বাস্তবতা কিন্তু সে কথা বলে না। এখন কাজ মানেই প্রবলেম সলভিং। গতানুগতিক ধারার কাজ কিন্তু এখন কমে যাচ্ছে। আর প্রবলেম সলভিং করার জন্য এখন গণিতে যেমন দক্ষ হতে হবে, তেমনি কোডিংয়ের ধারণাও থাকতে হবে। কোডিংয়ের দর্শন হচ্ছে যেকোনো সমস্যাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে সেটিকে সমাধান করা, ছোট ছোট সমাধান জোড়া দিয়ে বড় সমাধানে পৌঁছানো। দুটো দক্ষতাই এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকাংশ বাধ্যতামূলক।

আমার বাবা ব্যাংকার ছিলেন। ১৯৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ওনার প্রায় ৩০ বছরের ব্যাংকিং–জীবনে ওনাকে কোনো দিন কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয়নি। কিন্তু এখন কাউকে কি পাওয়া যাবে, ব্যাংকে যিনি কম্পিউটার ব্যবহার করেন না। বলতে পারেন ওয়ার্ড, এক্সেল বা কাস্টমাইজড সফটওয়্যারের সঙ্গে কোডিংয়ের কি সম্পর্ক? আছে। কোডিং করা থেকে একজন কেবল কোডিংটা শিখবেন না, শিখবেন সেগমেন্টেশন, একুইজিশন, ডকুমেন্টেশন। এগুলো খুবই দরকারি। প্রবলেম সলভিং তো আছেই।

ছোটবেলায় যে আমরা নানা কিসিমের অঙ্ক করি, সেটা বাস্তবজীবনে কেমন করে কাজে লাগে। যেভাবে লাগে সেভাবেই আপনার কাজে লাগবে কোডিংয়ের দক্ষতা। কোডিংয়ে যে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তা কিন্তু উন্নত দেশগুলো টের পেয়ে গেছে। গেছে বলেই তারা এটার পেছনে লেগে পড়েছে।
আগামী দিনে মাটি কাটার কাজ কিন্তু বিশেষ থাকবে না। মাটি যদি কাটতেই হয় সেটা প্রোগ্রামিং করেই কাটতে হবে, কোদাল-বেলচা দিয়ে নয়। আর এই সমস্যা সমাধানে পটু প্রজন্ম খোঁজার জন্যই আমাদের আয়োজন।

আমাদের স্বেচ্ছাসেবক মেন্টরদের দল এলাকা ছেড়ে চলে আসার পর কী হয় তা বোঝার জন্য এই দুইটি ছবি দেখা যায়। এটি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার জলিলনগর গ্রামের মহেশপুর মাধ্যমিক স্কুলের কম্পিউটার ল্যাবের ছবি। ছবি দুইটি দেখে চট করে এর মাহাত্ম্য বোঝা সম্ভব হবে না। তবে এটুকু বোঝা যাবে, কম্পিউটারে একদল ছেলেমেয়ে একটা কিছু করছে। ওরা আসলে কোডিং শিখছে। এতেও ব্যতিক্রমটা বোঝা যাবে না। আমাদের মেন্টররা সেখানে শতাধিক শিক্ষার্থীকে প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি দিয়ে এসেছে। এখন তারা আরও শিখতে চায়। আর তার জন্যই এই আয়োজন। কারা শেখাচ্ছে? ওদের স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, যারা ওদের থেকে একটু ভালো জানে। আর ওই ল্যাবটাও অদ্ভুত। কারণ, এখানে একটি মাত্র কম্পিউটারের সঙ্গে অনেক মনিটর ও কি-বোর্ড যুক্ত করে ল্যাবটা বানানো হয়েছে। সেখানেই তাদের চলছে শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং অন্বেষণ!

শুক্রবার ২ নভেম্বর ঢাকার গ্রিন রোডে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে এই প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে আমরা প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর কাছে প্রগ্রোমিংয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। এদের মধ্যে ৩ জনের ৫৮২টি টিম নিবন্ধন করেছে এবং তার থেকে অনলাইন বাছাইয়ের মাধ্যমে ১৫০টি দলকে নির্বাচন করা হয়েছে। সরাসরি সংযোগ ছাড়াও আমরা ভিডিও টিউটরিয়াল, হ্যাংআউট, সফল প্রোগ্রামারদের সঙ্গে আড্ডা, অনুশীলন কনটেস্ট, দুইটি অনলাইন মহড়া এবং অসংখ্য লেখা প্রকাশ করেছি প্রিন্ট, অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে।
আমি নিজেই অনেক শহরে ও স্কুলে গিয়েছি এবং একটি নীবর বিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পরামর্শ দিয়েছি। আমি নিশ্চিত জানি, আমাদের রিসোর্স কম, সুযোগ–সুবিধা সে রকম নেই; কিন্তু তারপরও জানি, আমাদের শিশু-কিশোররা আমাদের এক নতুন দিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা সফল হোক, সুন্দর হোক।

হ্যাপি প্রোগ্রামিং।
এ আগুন ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।

মুনির হাসান : যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক, প্রথম আলো।