ডলারের নতুন জুলুমবাজি

ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু করতে চান না। এর অর্থ এই নয় যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরের দেশগুলোতে শাসক অদলবদলের কারবার চালানো থেকে বের করে নিয়ে আসছেন। তাঁর প্রশাসন স্পষ্ট করেছে, ইরানের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তারা সেই একই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়, যে উদ্দেশে্য বুশ প্রশাসন ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালিয়েছিল।

২০১৫ সালে করা ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে গত মে মাসে বেরিয়ে আসার পর ট্রাম্প ইরানের শাসকদের ওপর চাপ বাড়ানোর উপায় খুঁজছেন। ৪ নভেম্বর দেশটির গুরুত্বপূর্ণ তেলশিল্পে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে অন্যান্য দেশের ওপর সম্পূরক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে, যাতে ইরান সম্পূর্ণরূপে ডলারভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থনীতির বাইরে চলে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইরানি ব্যাংকগুলোকে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) এবং বিশ্বব্যাপী অর্থ প্রদানব্যবস্থা থেকে দূরে রাখতে। এটা ইরানকে কার্যকরভাবে প্রাক্-বিশ্বায়ন অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ট্রাম্প এবং তাঁর উপদেষ্টাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে সুইফট কোনো মার্কিন সংস্থা নয়। এটি বেলজিয়ামভিত্তিক একটি নিবন্ধিত সংস্থা, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের পরমাণু চুক্তিকে সমর্থন করে।

ওসামা বিন লাদেন যে ধরনের আর্থিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নাইন–ইলেভেনের হামলা চালিয়েছিলেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেই ধরনের প্রতিটি আর্থিক ব্যবস্থার রাশ টেনে ধরছে, যাতে তারা বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কগুলো ধ্বংস করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে চরমপন্থী গোষ্ঠী ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনের সম্পদ জব্দ করার ওপর মূলত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সন্ত্রাসবাদ ও আর্থিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি স্টুয়ার্ট লেভি অন্য আরেকটি ধারণা কাজে লাগান। একবার বাহরাইন সফর করার সময় তিনি স্থানীয় সংবাদপত্রে একটি সুইস ব্যাংকের ইরানের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করা–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পড়েন। তখন তাঁর মাথায় এই ধারণা আসে যে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে তাঁদের বিবেচনায় ক্ষতিকারক দেশগুলোকে সরিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারি খাতের ওপর নিজেদের প্রভাব ব্যবহার করতে পারে।

এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করার জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে যে কোনো ব্যাংক ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করলে তার জন্য মার্কিন বাজার বন্ধ হয়ে যাবে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইরানের ওপর সেকেন্ডারি বা ‘সম্পূরক নিষেধাজ্ঞার’ জন্ম হয়। লেভির সম্পূরক নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত সফলতা লাভ করে। এর ফলে কোনো ব্যবসায়ী নেতা ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করার চেষ্টা কখনো করেননি। ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং গোষ্ঠী বিএনপি পারিবাসসহ যেসব ব্যাংক এই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছে, তাদের এত বিশাল অঙ্কের অর্থ জরিমানা করা হয়েছে যে তা বিশ্ব আর্থিক বাজারগুলোতে মারাত্মক অভিঘাতের সৃষ্টি করে।

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক হয়ে ওবামা প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এটা খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এবং ইরান অবশেষে আলোচনার টেবিলে এসেছিল, যেখানে দেশটি একটি চুক্তির অধীনে তাদের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম সীমিত করতে সম্মত হয়েছিল। যেহেতু ট্রাম্প ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তাই ইউরোপীয় নেতারা ইরানের জন্য কিছু সুবিধা বজায় রাখার উপায় খুঁজছেন, যাতে দেশটি পরমাণু কর্মসূচি পুনরায় চালু না করে। কিন্তু সুইফটের পরিচালকসহ ইউরোপীয় করপোরেট বোর্ডগুলোর সদস্যদের হুমকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে।

একই ধরনের হুমকি ইউরোপের প্রধান প্রধান সরকারি কর্মকর্তাকেও দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের পরিচালকদেরসহ ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির গুজব রয়েছে। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে জার্মানির বেসরকারি ব্যাংকগুলো যাতে ট্রাম্পের খামখেয়ালিমূলক সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য না হয়, সে জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বুন্দেস ব্যাংক’ তেহরানের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য একটি অ্যাকাউন্ট খোলার কথা বিবেচনা করছিল, কিন্তু হুমকির কারণে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া ছাড়াই তারা সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। কিন্তু তারাও খুব দ্রুত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

এখন ইউরোপীয়দের জন্য প্রশ্ন হলো কীভাবে তারা ‘ডলারভিত্তিক’ বাণিজ্যের জগতে তাদের অবস্থান ধরে রাখবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এখন আর্থিক খাতেও তাদের একই কাজ করতে হবে। ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হুমকির পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: রোকেয়া রহমান
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক