'রাষ্ট্র মেরামত' এখন সময়ের দাবি

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ কিশোরদের হাতে হাতে উজ্জ্বল যে প্ল্যাকার্ডগুলো আমাদের অনেককে ভাবিয়েছিল, অভিভূত করেছিল; তার একটিতে লেখা ছিল ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। কিশোরদের অভূতপূর্ব সুশৃঙ্খল আন্দোলনে প্রকাশিত সেই আকাঙ্ক্ষার তাত্পর্য অপরিসীম। সেদিনের কিশোরেরা সেই আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্যোগকে শাসকেরা রূঢ় হাতে দমন করেছিল বটে। কিন্তু যখন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা আরও গভীর, তখন আমাদের মনে হচ্ছে মেরামত ছাড়া এই রাষ্ট্রের কোনো গতি নেই।

কয়েক দশক ধরে আমরা দেখছি, যখনই নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসে, তখনই সরকার ফন্দি-ফিকির করতে থাকে এবং তাদের তত্পরতা দেশকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। এবারও তার অন্যথা ঘটেনি। জনমনে আশঙ্কা আছে, ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসীন বর্তমান সরকারের অধীনে আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। বিগত কয়েক মাসে সরকার স্বাধীন চিন্তা এবং ভিন্নমত প্রকাশের কারণে ঢালাওভাবে নাগরিকদের দমন-পীড়ন করেছে। বরেণ্য আলোকচিত্রী শহিদুল আলম প্রায় তিন মাস হলো কারাবন্দী এবং তাঁর জামিনের বিষয়টি ঝুলে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল সদ্য কারাভোগ করে বের হলেন। মুক্তিযোদ্ধা এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে করা হয়েছে একের পর এক মামলা। তাঁর প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং দখলদারি চালানো হয়েছে। একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতি জারি রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ঘটনায় আইনের অপপ্রয়োগ করে মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ড এবং জেল–জুলুম দেওয়া হচ্ছে। এমনকি আইনবহির্ভূত তৎপরতার মধ্য দিয়ে গুম ও খুনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া বাসচালক, কমিশনারসহ অনেককেই তাঁদের পরিবার আর জীবিত ফিরে পায়নি; বারবার অভিযোগ উঠেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের স্বজনদের তুলে নিয়ে গেছে।

এককথায় বলতে গেলে, বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি, যথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ, সামরিক-বেসামরিক আমলা, নীতিনির্ধারক এবং আইনপ্রণেতাদের বড় অংশ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থে সব প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি গুঁড়িয়ে দিয়ে জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি থেকে শুরু করে কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক, এমনকি প্রাণ–প্রকৃতি বাঁচানোর সামাজিক আন্দোলনকেও মাঠে নামতে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে, তাদের ঘোষিত কর্মসূচি ভূলুণ্ঠনের চেষ্টা করা হয়েছে। যুগপৎভাবে রাষ্ট্র এবং করপোরেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রিন্ট এবং ভিজ্যুয়াল সংবাদমাধ্যমের একটা অংশও এই নিপীড়ক ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক নাগরিকদের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা এবং মিডিয়াতে তা প্রচার সাংবাদিকতা পেশার শিষ্টাচার এবং নৈতিকতা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার নিকৃষ্টতম নজির।

এতগুলো টিভি চ্যানেল এবং পত্রপত্রিকা থাকা সত্ত্বেও জনগণ দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিষয়ে সঠিক সংবাদ ও বিশ্লেষণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করা হয়েছে, তাকে আড়াল করতে সরকার লাগাতারভাবে উন্নয়নের বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাচ্ছে। অথচ ব্যাংকসহ অর্থনৈতিক খাতের সীমাহীন নৈরাজ্য, উন্নয়ন প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতি এবং লুটপাট বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক, বিচারিক কিংবা নির্বাহী প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে এবং গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থে তাদের ব্যবহারের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা অবশিষ্ট থাকছে না। এ রকম ত্রাস, নিপীড়ন এবং স্বেচ্ছাচারিতা অব্যাহত থাকলে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। আশার কথা হলো, এমন নিপীড়নমূলক পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের জনগণ ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক পর্যায়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধ্যমতো প্রতিবাদ করছে। আমরা মনে করি, বিরাজমান অরাজক পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে মোটাদাগে দুটি বিষয়ে আশু উদ্যোগ জরুরি।

প্রথমত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। অনেকগুলো বছর ধরে একের পর এক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমান কমিশনও নির্বাচন আয়োজন প্রসঙ্গে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিংবা দল নিবন্ধনকরণের মতো নানা ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে অন্তরায়। অন্যদিকে নানা মহল থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দলনিরপেক্ষ এবং সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি উঠেছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সরকারও মাঠের দাবি নিয়ে নানা পক্ষের সঙ্গে সংলাপে বসার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সংলাপের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই এবং সংলাপকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা কিংবা রাজনৈতিক কূটকৌশলে আটকে না রেখে দেশ এবং জনগণের স্বার্থে একে কার্যকর এবং অর্থবহ করার আহ্বান জানাই। দেশের সব নাগরিক যাতে নিরাপদে, নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, তার জন্য করণীয় সংস্কার গ্রহণের দাবি জানাই।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হিসেবে জননিরাপত্তা এবং নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি জারি রয়েছে, তা কোনো সভ্য রাষ্ট্রে চলতে পারে না। অবিলম্বে বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ সব গুম-খুনের ঘটনা বন্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা আশু কর্তব্য।

আইনের নিবর্তনমূলক প্রয়োগের যে নজির সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সেটিও উদ্বেগজনক। বিলুপ্ত ৫৭ ধারা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ আইনের নানা ধারায় দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলায় নাগরিকদের গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা হয়েছে। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ধরনের নিবর্তনমূলক মামলায় আটককৃতদের মুক্তি এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দাবি করছি। সেই সঙ্গে দল, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই। সবশেষে নির্বাচন সামনে রেখে আমরা সব পক্ষকে মনে করিয়ে দিতে চাই, জাতিগত, ধর্মীয় কিংবা লিঙ্গীয়ভাবে প্রান্তিক মানুষজনকে রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার কিংবা দমন-পীড়ন করার যে ন্যক্কারজনক চল রয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যে অঙ্গীকারের কথা আমরা বলে থাকি, তার প্রতি সামান্য বিশ্বস্ততা থাকলে এই কাজ করা অবশ্যকর্তব্য।

আহমেদ কামাল, আনু মুহাম্মদ, রেহনুমা আহমেদ, ওমর তারেক চৌধুরী, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, মির্জা তাসলিমা, সাঈদ ফেরদৌস, অরূপ রাহী, সামিনা লুত্ফা ও অমল আকাশ

লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, আইনজীবী, শিল্পী এবং বাংলাদেশের নাগরিক