দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি

সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডটি একটু ব্যতিক্রমী। তবে তা এ কারণে নয় যে তাঁকে নৃশংস উপায়ে হত্যা করা হয়েছে কিংবা যারা এই 

হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে না। এটা ব্যতিক্রমী এ কারণে যে এ ঘটনা এমন একটি বিশ্বে আন্তর্জাতিক সংবাদে পরিণত হয়েছে, যেখানে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

শুধু ২০১৭ সালেই সারা বিশ্বে ৭৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয় এবং হাজার হাজার সাংবাদিককে তাঁদের কাজের জন্য লাঞ্ছিত বা কারাবন্দী করা হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দায়ে প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র একজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। মেক্সিকোর মতো দেশে ২০১৭ সালে ১২ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। কিন্তু সে জন্য কাউকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি।

এমনকি ইউরোপেও, যে স্থানটি কিনা সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেখানেও দুঃখজনকভাবে সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটছে। মাল্টার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডাফনে কারুয়ানা গালিজিয়ার পরিবার এখনো তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। এক বছর আগে বোমা হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। এভাবে একের পর এক সাংবাদিককে হত্যা করা হচ্ছে অথচ হত্যাকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

কিন্তু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই সহিংসতাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয় না এবং এরাই সাংবাদিকদের একমাত্র হুমকি নয়। খাসোগি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো আন্তর্জাতিক নেতাদের মধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অন্যতম। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির নির্দেশে খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে এবং যারা এই আদেশ পালন করেছে, তাদের সবাইকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’

অথচ ২০১৬ সালে সেনাবাহিনী এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টা চালানোর পর  তুরস্কের স্বাধীন গণমাধ্যমকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করেছেন এরদোয়ান। বর্তমানে সে দেশের ১৭৪ জন সাংবাদিক কারাগারে আছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। খাসোগি হত্যার সঙ্গে সৌদি আরবের জড়িত থাকা প্রসঙ্গে মন্তব্য করার সময় ট্রাম্প বলেন, ‘এভাবে বলার অনেক ঝুঁকি আছে, বিশেষত এ কারণে যে ওই ব্যক্তি একজন সাংবাদিক ছিলেন, হয়তো আপনি তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু জানতে পারবেন, যা কিনা সত্যিই ভয়ানক এবং ঘৃণ্য।’

এ কথা বলার মাত্র কয়েক দিন পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতার বিষয়টি উদ্‌যাপন করেন। তিনি রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান গ্রেগ জিয়ানফোর্টের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন, যিনি কিনা ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একজন সাংবাদিককে আক্রমণ করার দায়ে অভিযুক্ত হন। ট্রাম্প মন্টানাতে একটি সমাবেশে বলেন, ‘যে ব্যক্তি এটা করতে পারে, সে আমার লোক।’

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের প্রতি বিষোদ্‌গার করে আসছেন। তিনি এবং তাঁর প্রশাসনের কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। তিনি এ ধরনের খবরকে ‘ভুয়া খবর’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি গণমাধ্যমকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

যদিও মৌখিক আক্রমণ আর শারীরিক আক্রমণ এক নয়, কিন্তু এ ধরনের মৌখিক আক্রমণ একটি বৈরী পরিবেশ তৈরি করে; যা ২০১৮ সালে সাংবাদিকতা পেশাকে একটি বিপজ্জনক পেশায় পরিণত করেছে। মার্কিন গণমাধ্যম তাদের মতপ্রকাশে স্বাধীন বলেই পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সে দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অনেকখানিই খর্ব হয়েছে এবং সারা বিশ্বে তার প্রভাব পড়েছে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সাংবাদিকদের মানহানি করা ও আক্রমণের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর এবং এ ক্ষেত্রে যারা কাজ করে, তাদের ওপর জনগণের আস্থাকে কমিয়ে দেয়। প্রস্তাবে নারী সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে জাতীয় কৌশল গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।

এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে আজকে আমাদের বিশ্বকে মনে করিয়ে দিতে হয় যে সাংবাদিকেরা খুন হচ্ছেন আর তাঁদের হত্যাকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। সরকারগুলোকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের সুরক্ষার জন্য সাংবাদিকদের বাছাই করতে পারবেন না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়মুক্তির অবসানের যুদ্ধ শুরু করতে হবে সব সরকারকে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। অনুবাদ: রোকেয়া রহমান

টমাস হিউজ, ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন অর্গানাইজেশনের নির্বাহী পরিচালক