রাজনীতি থেকে তারুণ্য মাইনাস কেন

গত হপ্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারি দলের ২৩ নেতার সঙ্গে বিরোধী দলের ৪০ জনের বেশি খ্যাতিমান নেতার দুটি সম্মেলন বা সংলাপ হয়ে গেল। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তাঁরা মূল্যবান কথা বলে দুই দিনে কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করেছেন। এদিকে তাঁদের সংলাপ-কার্য-নৈশভোজ নিয়ে বাইরে থেকে আমরা অনেকেই এক শ গুণ বেশি বাক্য ব্যয় করেছি। সংলাপে যেসব আলোচনা হয়েছে, তার ভাবসম্প্রসারণ করার অবশিষ্ট আর কিছু নেই। ওদিকে জনগণ অর্থাৎ সোয়া ১৬ কোটি মানুষ যা বোঝার তা নিজেরাই যার যার মতো বুঝে নিয়েছে। সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে বিরোধী দলের নেতাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সংলাপে কেউ সন্তুষ্ট, কেউ অসন্তুষ্ট হলেও সেখানে যে খানাপিনা হয়েছে, তাতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ঘোরতর সরকারবিরোধী নেতারাও।

সংলাপের পরে নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা বেড়েছে কি কমেছে, তা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। আমি যে জিনিসটি লক্ষ করেছি তা হলো, দুই দিনের বৈঠকে তিন পক্ষে যাঁরা ছিলেন তাঁদের প্রায় কারও বয়সই ৬০-এর নিচে নয়। অধিকাংশই এখন ৭০-এর কোঠায়, কেউ কেউ অশীতিপর। তা হলে বাংলাদেশে ৪০ এবং ৫০-এর কোঠার রাজনৈতিক নেতা কি নেই।

বাংলাদেশ, উপমহাদেশ এবং অন্যান্য দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সব সফল নেতারই যাবতীয় অর্জন ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। ভারতবর্ষের মুনি–ঋষিরা বলে গেছেন ‘পঞ্চাশোর্ধে বমং ব্রজেৎ’ অর্থাৎ পঞ্চাশ বছরের পরে হয় বানপ্রস্থ বা বাড়িতেই চুপচাপ বসে থাকো, নয়তো বনে চলে যাও। এখন মানুষ, বিশেষ করে পুরুষ ৫০ বছরে যুবতীকে বিয়ে করে। সুতরাং বানপ্রস্থ বা বনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৪ বছর বয়সে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মন্ত্রী হয়েছিলেন ৩৬ বছর বয়সে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন ৫১ বছর বয়সে। তাজউদ্দীন আহমদ ২৯ বছর বয়সে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন ৪৬ বছর বয়সে।

উপমহাদেশের শীর্ষ নেতা মহাত্মা গান্ধী ২৫ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে অহিংস আন্দোলনের সূচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ৫১ বছর বয়সে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়িয়ে দেন। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ৪৭ বছর বয়সে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মহারাষ্ট্রে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে বোম্বে (মুম্বাই) থেকে তাঁর বিরুদ্ধে যে দুজন দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। জওহরলাল নেহরু ৪০ বছর বয়সেই ভারতের একজন প্রধান নেতা এবং ৫৬ বছরে প্রধানমন্ত্রী হন। সুভাষচন্দ্র বসু ৪১ বছর বয়সে নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন, ‘নেতাজি’ উপাধি দেয় দেশবাসী এবং ৪৫ বছর বয়সে তাঁকে সম্বোধন করা হয় ‘রাষ্ট্রপতি’। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেন ‘দেশনায়ক’।

মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের হাতে শাহাদত বরণ করেন ৪৯ বছর বয়সে। সূর্য সেনের ফাঁসি হয় ৪১ বছর বয়সে। যে আজ্ঞাবহ বিচারক তাঁর ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন, আমাদের দৃষ্টিতে তিনি আজ অপরাধী। তাঁকে বাঙালি কোনো দিন ক্ষমা করবে না। মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জন্মভূমির মুক্তির জন্য আত্মাহুতি দেন। জনগণের নেতা হওয়ার জন্য ৭০-৮০ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।

২০ থেকে ৫০ বছর—এই ৩০ বছর একজন মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময় মানুষের যে সাহস ও শারীরিক শক্তি থাকে, ৭২-এ গিয়ে তা থাকে না। অন্যান্য দেশের নেতাদের দিকে তাকালেও তা–ই দেখা যায়। আমেরিকার জনগণ বুড়ো প্রেসিডেন্ট পছন্দ করে না। সব সফল প্রেসিডেন্টই মধ্যবয়সী। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে সুকর্ণ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। মিসরের নেতা জামাল আবদুল নাসের মাত্র ৩৮ বছর বয়সে রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল চীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঝৌ এনলাই ৫১ বছর বয়সে। কিউবার শাসনভার যখন কাঁধে তুলে নেন ফিদেল কাস্ত্রো, তখন তিনি বলতে গেলে বাচ্চা ছেলে। কাস্ত্রোর বন্ধু চে গুয়েভারা ৪০ বছর বয়সের আগেই সমগ্র লাতিন আমেরিকার পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শাসকদের ত্রাসে পরিণত হন। মার্টিন লুথার কিং, যাঁর ছিল ‘একটি স্বপ্ন’, ৩০ বছর বয়সেই মহানায়কের ভাবমূর্তি অর্জন করেন। ইরানে পাহলভি রাজপরিবারকে উৎখাত করে ৮০ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ খোমেনি যে ইসলামি বিপ্লব করেন, তাঁর সরকারের মন্ত্রীদের অধিকাংশের বয়স ছিল ২৫ থেকে ৪০-এর মধ্যে। তিরিশের কোঠার মন্ত্রী ছিলেন বেশি।

আমাদের জন্য অন্য দেশের দৃষ্টান্তের প্রয়োজন নেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে এবং রণাঙ্গনের বাইরে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের সবাই ছিলেন ৪০ বছরের কম বয়স্ক, কারও কারও বয়স ৩০-এর নিচে। তাঁদের ছিল সংকল্প ও সাহস।

আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তারুণ্য নির্বাসিত। সব দলেই বুড়োরা নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখতে চান। তাঁরা যে ব্যর্থ নন, সে প্রমাণ দিতে পারেননি। তাঁরা সফল হলে জাতিসংঘের মহাসচিবের দূত হয়ে বাংলার মাটিতে কেউ মাস্টারি করতে আসতেন না। ১৬ কোটি মানুষের জন্য সে এক বেজায় বেদনার বিষয়।

বাংলাদেশের তরুণদের আজ কি মেধা ও যোগ্যতার এতই অভাব? মোটেই বিশ্বাস করি না। আজ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। অর্থনৈতিক উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই তরুণ। সফল উদ্যোক্তাদের অনেকেরই বয়স ৩৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। রাজনীতিতে তারুণ্যের অনুপস্থিতি কেন? তাহলে কি রাজনীতি করার যোগ্যতা তরুণেরা হারিয়ে ফেলেছেন? নাকি রাজনীতির ওপর তাঁরা আস্থা হারিয়েছেন? এর কোনোটাই সত্য নয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দলের ছাত্র-যুব সংগঠনে বহু মেধাবী তরুণ রয়েছেন এবং গত ৩০ বছরে তেমন তরুণ নেতা অনেকে ছিলেন। তাঁরা কোথায় গেলেন?

যখনই কারও ভেতরে সম্ভাবনা দেখা গেছে, তখনই নেতারা তাঁকে সুকৌশলে সরিয়ে দিয়েছেন নিজেদের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে। রাজনীতি থেকে তারুণ্যকে সুপরিকল্পিতভাবে মাইনাস করা হয়েছে। দায়িত্ব থেকে তাঁদের দূরে রাখা হয়েছে। তাঁদের উপহার দেওয়া হয়েছে মোটরসাইকেল। নেতারা যাবেন এসি গাড়িতে। তাঁদের সামনে–পেছনে তরুণেরা ছুটবেন রোদের মধ্যে। দেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের; বৃদ্ধদের নয়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংলাপের বৈঠকে কোনো তরুণ নেতার স্থান নেই।

বৃদ্ধ ও বিত্তবানদের আজ বাংলাদেশে আধিপত্য। বুদ্ধিমানের চেয়ে চালাকের দাম বেশি। আগামী সংসদেও সম্ভবত তাঁরাই যাবেন, যাঁরা ষাট বা সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ অথবা বিপুল বিত্তের অধিকারী। যাঁদের বিদেশি ব্যাংকে টাকা আছে গচ্ছিত, অথবা কোথাও ভিনদেশে আছে দ্বিতীয় বাড়ি এবং বাংলাদেশে কয়েকটি বাড়ি ও বাগানবাড়ি রয়েছে—তাঁরাই তো এখন রাজনীতিবিদ। আজ তারুণ্য নির্বাসিত বলেই টাকাওয়ালাদের আধিপত্য।

একজন নাগরিক হিসেবে আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়স্ক কোনো জাতীয়তাবাদী প্রগতিপন্থী নেতা। তাঁর ৪০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদের দু–চারজন বাদে সব সদস্যেরই বয়স হবে ৩৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক মানুষের মধ্যে স্বপ্ন থাকে, সাহস থাকে, লক্ষ্য থাকে এবং লক্ষ্য অর্জনের মনোবল থাকে, দক্ষতা ও শারীরিক শক্তি থাকে। বৃদ্ধদের মাইনাস করা হবে না। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে পরামর্শ দিয়ে তরুণদের সফল হতে সাহায্য করবেন। তাঁরা থাকবেন শ্রদ্ধার আসনে। তরুণেরা থাকবেন একটি অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক