কোটা নিয়ে বিকল্প ভাবনা

এত দিন সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ ছিল কোটায়, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য, ১০ শতাংশ জেলা, ১০ শতাংশ নারী, ৫ শতাংশ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট কোটায় কৃতকার্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা থেকে পূর্ণ করার বিধান ছিল, তথাপিও অধিকাংশ পদই যেহেতু কোটায়, সেহেতু কোটাপদ্ধতির সংস্কারের জন্য বিগত এপ্রিল মাসে ছাত্রদের একটি স্বতঃস্ফূর্ত এবং বড় আন্দোলন হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ হস্তক্ষেপে এই আন্দোলনটি যৌক্তিক পরিণতির অপেক্ষায় স্থগিত হয়; অতঃপর নানা দীর্ঘসূত্রতা পেরিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদগুলোর জন্য গত সেপ্টেম্বর মাসে কোটাপদ্ধতি বাতিল করা হয়। উল্লেখ্য,  ২০১৩ সালের জুলাই মাসেও এ রকম একটি আন্দোলন হয়েছিল।

অতি সম্প্রতি সরকারের বদান্যতায় সরকারি চাকরির বেতন-ভাতা প্রায় দুই গুণ হয়ে যাওয়ায় সরকারি চাকরি যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পে কমিশনের উদার সুপারিশের ভিত্তিতে এ ধরনের একটি বেতনকাঠামো প্রকাশের কিছুদিন পরই যখন সরকারের প্রায় ১ হাজার ৫০০ উপসচিবের জন্য গাড়ি বাবদ ঋণ ৩০ লাখ টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকা অনুমোদিত হলো, তখন এই চাকরির প্রতি আকর্ষণ শতগুণে বেড়ে গেল। গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় মূল বেতনের সমান বরাদ্দ! এমনকি উদার পে কমিশনও এই বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনটি তখন উপলব্ধি করতে পারেনি। যা হোক, কোনো চাকরি যখন আকর্ষণীয় হয়, তার জন্য চাকরিপ্রার্থীরা সব ধরনের সুযোগ খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক।

কিছুদিন আগেও প্রচলিত কোটাপদ্ধতির বদৌলতে যে সুবিধাদি বিদ্যমান ছিল, তা ফিরে আসতে পারে—এই আশায় সংশ্লিষ্ট অনেকে এখন আবার আন্দোলনে নেমেছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে দাবিদাওয়া আদায়ের ‘প্রেসক্রিপশন’ অনুযায়ী যদি শক্তি প্রকাশ করতে পারেন, তাহলে হয়তো দাবি আদায় হয়েও যাবে—ন্যায্যতার প্রশ্ন হয়তোবা তেমন একটা আসবে না; যদিও আমাদের সবারই আশা দেশটি বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নয়, বরং যুক্তি, জ্ঞানে, দক্ষতায় উন্নতির পথে অগ্রসর হোক। এখানে উল্লেখ্য যে ন্যায্যতার প্রশ্নে কোটা আন্দোলনের কিন্তু বেশ শক্ত একটা অবস্থান ছিল এবং সে জন্য এর প্রতি জনসমর্থনও ছিল বলেই আমাদের মনে হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে আন্দোলনকারীদের মূল দাবি কিন্তু ছিল কোটা সংস্কার, তা বাতিল করা নয়। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য বিভিন্ন কোটার শতকরা ভাগসহ কোটা পূরণসংক্রান্ত অন্যান্য বিধিমালা সংস্কার করা যেত হয়তো।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। যাঁরা জীবন বাজি রেখে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তাঁদের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা আর কৃতজ্ঞতা! অবশ্যই এই প্রকাশ যথেষ্ট নয়। তাঁদের এই আত্মত্যাগ, দেশের জন্য ভালোবাসা যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে আবেশিত করা যায়, তার জন্য নানা রকম স্মৃতিস্মারকও তৈরি করা দরকার। তাঁদের বীরত্বগাথা গ্রন্থাগারে, স্কুলে-কলেজে, খেলার মাঠে ও অন্যান্য দৃশ্যমান জায়গায় সংরক্ষণ করা উচিত। অবশ্যই তাঁরা নিজেদের সন্তানদের শ্রেয়তর জীবনযাপন পছন্দ করতেন, এটা স্বাভাবিক। আমাদের মধ্যেই বাস করছেন এমন অনেক (যুদ্ধাহত) মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের সন্তানসন্ততি, যাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের দিয়েছে নিরাপত্তা কিন্তু তার মূল্য শুধতে হচ্ছে তাঁদের উত্তর-পুরুষকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে একটি নিরাপদ জীবন বেছে নিলে হয়তো তাঁদের জীবন এবং তাঁদের উত্তর-পুরুষদের জীবনযাপন অন্য রকম হতে পারত। তাই তাঁদের এই বিষয়টিও আমাদের সমাজকে দেখতে হবে।

তাত্ত্বিক কথা হলো, একজন মানুষের ভালো-মন্দ কাজের ভাগ তাঁর সন্তানাদি কিংবা পিতামাতা পাবেন না। তবে বাস্তবে পিতামাতা যা রেখে যান তা সন্তানেরা উপভোগ করেন এবং পিতামাতার আকাঙ্ক্ষাও তা–ই থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই কোটা সুবিধাগুলো যদি চলতে থাকে, সময়ের পরিক্রমায় একপর্যায়ে গিয়ে সম্ভবত আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। কারণ, তখন যেকোনো নাগরিকই কোনো না কোনোভাবে একজন মহান মুক্তিযোদ্ধার উত্তর-পুরুষ হয়ে যাবেন; যদিও সেই সময় কোনো একজনের একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার—এই দুইয়েরই উত্তরসূরি হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশের মানুষের জন্য একটি স্বাধীন দেশ চেয়েছিলেন, যেখানে আমাদের সমাজ ক্রমাগতভাবে উন্নতি করে যাবে, সাধারণ মানুষের দুর্দশার লাঘব হবে। সেই অর্থে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের হতে হবে দেশপ্রেমিক এবং মেধাবী। অন্যদিকে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে একজন তাঁর পিতামাতা কিংবা পূর্বপুরুষের কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি বলে বঞ্চিত হতে চাইবেন—এ রকমটি ভাবারও কারণ নেই এবং তা ন্যায্যও নয়।  কোটাপদ্ধতি প্রবর্তনের মূল মর্ম হলো, কোনো গোষ্ঠী বঞ্চিত হলে কিংবা পিছিয়ে থাকলে, তাদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।

একেবারেই সরলরৈখিক চিন্তা না করে একটি বিকল্প ভাবনার সূচনা করতে চাই, যা নিয়ে বিজ্ঞজনেরা ভাবতে পারেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা যাতে নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে একই সূচকের বিচারে চাকরি পেতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের যে ব্যক্তিস্বার্থ হানি হয়েছে, সে কথাটি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রেখে শ্রেয়তর জীবনের লক্ষ্যে তাঁদের সন্তানদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হোক এবং তা বিনা ফিতে। যেমন তাঁদের শিক্ষার মানকে উন্নত করার জন্য বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। আমরা আশা করতে পারি যে যাঁদের দেহে প্রবাহিত হচ্ছে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত, তাঁরা নিশ্চয়ই দেশের কল্যাণে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট এবং সক্ষম হবেন।

একই রকম ব্যবস্থা অন্যান্য কোটা-সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্যও করা যেতে পারে। আমরা যদি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুব্যবস্থা করে দিতে পারি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আর কর্মক্ষেত্রে কোটার জন্য আন্দোলন করতে হবে না; আর কোটাধারী বলে কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন ধাপেও তাঁদের কোনো তির্যক দৃষ্টি সহ্য করতে হবে না।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদড. মো. সোহেল রহমান : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক