তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ...

শ্যামল কান্তি ভক্ত
শ্যামল কান্তি ভক্ত

অন্যায়ভাবে লাঞ্ছিত নারায়ণগঞ্জ পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে জেলেও যেতে হয়েছিল। এখন তিনি জামিনে আছেন। অথচ তাঁকে যাঁরা লাঞ্ছিত করলেন, তাঁরা ক্ষমতাবান হওয়ায় এবং আরও বিশেষ করে উচ্চতর ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। যিনি নির্যাতিত, তিনিই এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। হায়! এ কোন উল্টো বিচারের দেশ!

রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে—‘দুই বিঘা জমি’। এক জমিদার মিথ্যা মামলা দিয়ে চুরি করে নিয়েছিল দরিদ্র উপেনের দুই বিঘা জমি। সর্বহারা হয়ে উপেন বহুদিন নানা জায়গা ঘুরেফিরে এসেছিল তার নিজ গ্রামে। সেই জমিতে, যা জমিদারবাবু মিথ্যা ডিক্রি জারি করে দখল করেছে, বলা যায় চুরি করেছে। উপেন তারই জমিতে আমগাছতলায় বসে ছিল। দুটো পাকা আম তার কোলের ওপর পড়লে জমিদারবাবু ও তার লোকজন হইহই শুরু করে। উপেনকেই চোর সাব্যস্ত করেছিল। দুঃখভারাক্রান্ত মনে উপেন বলেছিল, ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে’।

আজকের দিনের কোনো কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি সেই যুগের জমিদারদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান এবং দুর্নীতি, মিথ্যাচার ও অন্যায়-অত্যাচারের দিক দিয়ে সেকালের জমিদারদেরও হার মানায়। নারায়ণগঞ্জের সেলিম ওসমান শুধু সাংসদ নন, তাঁর পরিবার ক্ষমতার উচ্চতর জায়গার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং আশীর্বাদপুষ্ট। তাই ব্যক্তি শিক্ষককে অপমান করলেও তাঁর কিছু হয় না; বরং উল্টো শিক্ষকই মিথ্যা মামলা, জেল, হয়রানি, ভয়ভীতির শিকার হন।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমি তিনটি বিষয় আলোচনায় আনতে চাই। ১. সাম্প্রদায়িকতা, ২. শিক্ষার মান ও শিক্ষকের সম্মান, ৩. বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

সাম্প্রদায়িক উসকানি ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ রূপ পেয়েছে। এটা যে কেবল কিছু হিন্দুবিদ্বেষী ধর্মীয় মৌলবাদী দল করছে, তা-ই নয়, সেক্যুলার বলে পরিচিত সরকারি দলও কম যায় না। দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর সবলের অত্যাচার নতুন কিছু নয়। তবে দেশে সুশাসন বা আইনের শাসন থাকলে এর প্রকোপ ও পরিমাণটা কম হতো। যেহেতু দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, সেহেতু ক্ষমতাবানেরা যা খুশি করার সুযোগ, বলা যায় একধরনের অধিকার পেয়েছে। তাদের জন্য সহজ ভিকটিম হলো তারাই, যারা ধর্মীয়ভাবে বা নৃতাত্ত্বিক দিক দিয়ে সংখ্যালঘু। সে জন্য দেখি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বা সমতলের সাঁওতাল প্রমুখ আদিবাসী নানাভাবে প্রতারণা ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। বাঙালিদের মধ্যেও ধর্মীয় বিভাজন টেনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়–সম্পত্তি দখলের প্রবণতা প্রথম থেকেই ছিল, এখনো আছে।

সামাজিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে জনমত উসকে দেওয়া খুব সহজ। বললেই হলো যে তারা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করেছে। নাসিরনগরের ঘটনায় আমরা এটাই দেখেছি। মিথ্যা অজুহাতে এক নিরীহ হিন্দু ভদ্রলোককে জেলহাজতে যেতে হলো এবং একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। তখনো সরকারদলীয় নেতাদের নাম শোনা গিয়েছিল। তাঁরা প্রকাশ্যে হিন্দুদের সম্বন্ধে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। পুলিশও নিষ্ক্রিয় ছিল। আসল মতলব ছিল জমি দখল। রামুর ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত—সব দলের কর্মীরা জড়িত ছিলেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত অভিযোগ করেছিলেন, কয়েক বছর ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত হামলায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা জড়িত ছিলেন।

প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্কুল থেকে তাড়ানোর লক্ষ্যে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হলো—তিনি নাকি ছাত্রদের কাছে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন। যেকোনো হিন্দুধর্মাবলম্বীর বিরুদ্ধে এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে দিয়ে তাকে আরও অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া সহজ। মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা শুনেও সাধারণ মানুষ সেখানে জড়ো হয়নি। হয়েছিল সাংসদের সমর্থক কিছু লোক। সেদিন শুধু হিন্দু বলেই একজন শিক্ষককে এমনভাবে অপমানিত হতে হলো। এটা যদি আমাদের সংস্কৃতি হয়, তাহলে তো হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ এ দেশে সামাজিকভাবে নিরাপদ বোধ করবে না। হয়তো দেশত্যাগ করবে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও, এমনকি আওয়ামী লীগ সাড়ে আট বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের প্রবণতা কমেনি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ, প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রকাশ্যে যেভাবে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছে, তা কোন সাংস্কৃতিক মানের পরিচয় বহন করে? হাজার হোক, তিনি একজন শিক্ষক। তাঁকে এভাবে প্রকাশ্যে অপমান করতে পারা যায়, তাদের সাংস্কৃতিক মান যে কত নিচু, তা কি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে?

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, (৩ জুন ২০১৭) ‘এই ঘটনার ভিডিওচিত্রে তাঁকে (শ্যামল কান্তি ভক্ত) কান ধরে ওঠবস করানোর নির্দেশ দিতে দেখা যায় স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানকে।’ সেলিম ওসমান সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির সাংসদ। তাঁর ভাই শামীম ওসমান সরকারদলীয় সাংসদ এবং পরিবারটি দীর্ঘকাল ধরে সর্বোচ্চ ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট। সে জন্যই হয়তো এমন দাপট দেখাতে পেরেছেন সাংসদ সেলিম ওসমান।

ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট বলে সেই ঘটনায় সেলিম ওসমানের কোনো শাস্তি এখনো হয়নি। বরং দেখেছি, তাঁর পক্ষে পুলিশ প্রশাসনও ভূমিকা রেখেছে। আরও রেখেছিল হেফাজতে ইসলাম। গত বছর এ ঘটনা ঘটার পর নারায়ণগঞ্জে পাশাপাশি দুটি পাল্টাপাল্টি সভা হতে দেখেছি। একদিকে শিক্ষকের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সমাবেশ, যাঁরা শিক্ষকের লাঞ্ছনায় মর্মাহত, প্রতিবাদমুখর। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম, যারা সেলিম ওসমানের পক্ষ নিয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য দেয়।

ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইনের ঊর্ধ্বে থাকেন। দুর্বলরা বিচার পান না। শ্যামল কান্তিকে যারা প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করল, তাদের বিচার হয় না। উল্টো মামলায় জড়িয়ে হাজতবাস করেন শ্যামল কান্তি ভক্ত। চার বছর পরও ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি। ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথম আলোয় এক নিবন্ধে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি অভিযোগ করেছেন: ত্বকীর হত্যাকারী কারা, তা সকলেরই জানা। র‌্যাব অনেক আগেই সংবাদ সম্মেলন করে হত্যাকারীদের নাম বলেছিল। দুজন আসামি অপরাধ স্বীকার করে কোর্টে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন। তবু বিচারের কাজ শুরুই হয়নি। ২০১৩ সালে কিশোর ত্বকীকে হত্যা করা হয়। আজও পর্যন্ত কোর্টে অভিযোগপত্র পেশ করা হয়নি। প্রথম আলোর নিবন্ধে ত্বকীর বাবা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘ত্বকী হত্যার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তরা সরকারদলীয় হওয়ার কারণেই এ হত্যার অভিযোগপত্র আটকে আছে বলে অনেকে মনে করেন।’

বরং আমরা দেখলাম, নিহত ত্বকীর বাবার বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছে। তিনি অবশ্য জামিনে আছেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই মামলাটি পুলিশ গ্রহণ করেছে হেফাজতের দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে, যে হেফাজত ২০১৩ সালের ৫ মে অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার মাধ্যমে সরকারের পতন করতে গিয়েছিল, তারাই এখন রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে। ত্বকীর বাবা বিচার চেয়ে ‘অপরাধী’। লাঞ্ছিত শিক্ষককেও জড়ানো হয়েছে কথিত ঘুষ নেওয়ার মামলায়। দুটোই নারায়ণগঞ্জের ঘটনা। দুটোর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবার জড়িত বলে শোনা যায়। মোটকথা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে।

সম্মানিত শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন। আমরাও তাঁর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে বলব, শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেছে যারা, তারা যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের বিচার হোক, শাস্তি হোক, শিক্ষক সমাজের সম্মানের স্বার্থে, একই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনার স্বার্থে। সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যা মামলাও তুলে নেওয়া হোক।

সবশেষে একটা কথা যোগ না করলেই নয়। শ্যামল কান্তি ভক্ত যে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর দুঃখের কথা ও দাবি জানিয়েছেন, সেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল জাতীয় হিন্দু মহাজোট। হিন্দু মহাজোট কেন? একজন হিন্দু শিক্ষক অপমানিত হয়েছেন বলে কি শুধু হিন্দুদের সংগঠন প্রতিবাদ করবে? এতে তো সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়বে বই কমবে না। এমন কোনো ধর্মনিরপেক্ষ সংস্থা, সংগঠন পাওয়া গেল না, যারা এই সংবাদ সম্মেলন করতে পারে?

শ্যামল কান্তি যখন অপমানিত হয়েছিলেন, তখন তো হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে সব শুভবুদ্ধির মানুষ প্রতিবাদ করেছিলেন। এখনো তা-ই করা উচিত। আমাদের ধর্মীয় সংকীর্ণতার, ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক ও গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে আঁকড়ে ধরতে হবে। সেলিম ওসমান প্রমুখ যা করেছেন, তা সাম্প্রদায়িকতা। একে প্রতিরোধ করতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা দ্বারা। হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নামে সংগঠন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নিষিদ্ধ করেছিলেন ১৯৭২-এর সংবিধানে। জিয়াউর রহমান সেটা বাতিল করেন। বঙ্গবন্ধুর দল ক্ষমতায় থাকলেও তা এখনো ফিরে আসেনি। কিন্তু আমরা চাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন যেন গড়ে ওঠে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের মাধ্যমে।

অন্যথায় আমরা আবার আরেকটা অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হব। প্রতিবাদী গণতান্ত্রিক মানুষকে তাই সচেতন থাকতে হবে।

হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।