উগ্রপন্থার ঢেউ ঠেকাতে পারবেন ইমরান?

ধর্ম অবমাননার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসিয়া বিবিকে সুপ্রিম কোর্ট শেষ পর্যন্ত খালাস দেওয়ায় তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানের সমর্থকেরা তিন দিন ধরে বিক্ষোভ করছেন। এতে গোটা দেশে একধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কট্টর মতাদর্শ ও সমাজের ক্রমবর্ধমান বিভক্তি আবারও দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে। ৭২ ঘণ্টা পরও সরকার এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যা দেখে বোঝা যাবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখা ও উত্তেজনা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা এই সরকারের আছে।

ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতৃত্বাধীন সরকার পাকিস্তানের অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে যতটা জোর দিয়ে এসেছে, ততটা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর দেয়নি। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটি এখনো খালি। অবশ্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শাহরিয়ার আফ্রিদিকে নিয়োগ দিলেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজের হাতেই রেখেছেন। ধারণা করা যেতে পারে, অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে তিনি এখনো পর্যন্ত নিজের বাইরে আর কাউকে ততটা ভরসা করতে পারছেন না।

২০১৪ সাল থেকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা কমতির দিকেই রয়েছে। এ প্রবণতা মোটামুটি এখনো জারি আছে। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত হবেন, পাকিস্তানে উগ্র মতাদর্শ আবার জোট পাকাতে শুরু করেছে এবং তা জাতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে।

পেশোয়ারে স্কুলে হামলার পর সরকার সন্ত্রাস কঠোরভাবে দমন করেছে এবং এখনো সেই কঠোর মনোভাব থেকে সরে আসেনি। কিন্তু পাকিস্তানের যে নাগরিকেরা সরাসরি জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত নয়, কিন্তু মনেপ্রাণে কট্টর মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাদের বিষয়ে সরকারকে সতর্কভাবে এগোতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যাবে না, বরং নমনীয়ভাবে বিষয়টিকে সামাল দিতে হবে। এ জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা মাথায় রেখে উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। কিন্তু এটি বলা যত সহজ, করা ততটাই কঠিন। এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের পক্ষে উগ্রবাদ প্রতিহত করতে কোনো লাগসই কার্যক্রম হাতে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুলে সন্ত্রাসী হামলার পর গোটা পাকিস্তানে একটি জাতীয় ঐক্য ও সংহতির চেতনা কাজ করেছিল। পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তার স্বার্থে সেই চেতনা ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান সরকার সে ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে, তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

চলতি বছরের মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল ইন্টারনাল সিকিউরিটি পলিসি (২০১৮-২৩) বা এনআইএসপি নামের একটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে। গত দুই দশকের পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে এনআইএসপি তাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছে। টানা ১০ মাস এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ জন্য যাঁদের পরামর্শ ও মতামত নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, পার্লামেন্ট সদস্য, সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞসহ নানা শ্রেণি-পেশার লোক ছিলেন।

এনআইএসপি নামের এই নিরাপত্তা নীতি প্রণয়নে পিটিআই, পিএমএলএন, পিপিপিসহ বড় বড় দলের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয়েছে। গত নির্বাচনে এসব দলের ইশতেহারেও এই নীতি সমর্থনের প্রতিফলন ছিল। ক্ষমতাসীন পিটিআই দলের ইশতেহারে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কথা খুব জোর
দিয়ে বলা হয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি তারা ব্যাপকভাবে সামাজিক সংস্কারের দিকে যাবে। উগ্রপন্থাবিরোধী প্রচারণায় মাদ্রাসা ও মসজিদের লোকজনের সহায়তা নেওয়া হবে।

সম্প্রতি পিটিআইয়ের দলীয় বৈঠকে বিষয়টি উঠেছে। নাগরিকদের ধর্মীয় ও জাতীয়তার পরিচয় যেন সাংঘর্ষিক অবস্থায় না যায়, সে জন্য কী কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা ও আলেম-ওলামার সঙ্গে সরকারের প্রতিনিধিরা কথাও বলেছেন। এখন আসিয়া বিবি ইস্যুতে পাকিস্তান যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তাতে মনে হচ্ছে জনগণের বিরাট অংশ এখনো কট্টরভাবাপন্ন রয়ে গেছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ইমরানের সরকারকে সব দিক সামাল দিতে গলদঘর্ম হতে হবে।

ইমরান খানের প্রতি ইসলামপন্থীদের অনেকের সমর্থন আছে। ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অন্য নেতাদের তুলনায় বেশি বলে অনেক পাকিস্তানির ধারণা। এ কারণে তাঁর পক্ষে কট্টরবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁকে নমনীয়ভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। আবার আদালতের রায় বাস্তবায়নও তাঁকে করতে হবে। এই কঠিন অবস্থা সামাল দেওয়াকে ইমরানের রাজনৈতিক পরীক্ষার অংশও বলা যেতে পারে।

ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

আদনান রফিক: পাকিস্তানের লেখক