চলমান সংলাপ

জাতীয় রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার বিষয়ে সংলাপকে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখাই সমীচীন। গতকাল দ্বিতীয় দফা সংলাপ শেষে ঐক্যফ্রন্টের আন্দোলনের পাশাপাশি ‘আরও আলোচনার’ আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনায়’ বসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। কোনো পক্ষই যে হতাশা প্রকাশ করেননি, তা ইতিবাচক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা উভয় পক্ষ একমত হলে নির্বাচন পেছানো সম্ভব বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা–ও ইতিবাচক। তবে যখন আজ তফসিল ঘোষণা হচ্ছে তখনো সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তা জাতির জন্য হতাশাজনক।

সংসদ ভেঙে না দিয়ে সম্পূর্ণ দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার নিশ্চয় মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। এই অঙ্গীকারের প্রতি আস্থাশীল থেকে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না, তা এখনো অস্পষ্ট। ফলে নির্বাচন নিয়ে গুমোট অবস্থা কাটছে না। এই রূঢ় বাস্তবতায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অনুধাবন করতে হবে যে আগামী নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত কোনো কারণে অংশগ্রহণমূলক না হলে তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। যতই সংবিধানের দোহাই দেওয়া হোক, পুনরায় একতরফা বা ঘোরতর অনিয়মদুষ্ট নির্বাচনে যেতে হলে বৈধতার সংকট আরও গভীরতর হবে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘মুক্তি’ আদালতের বিষয় বলে সরকারি দল যে যুক্তি দিচ্ছে, তার ভিত্তি আছে। আবার বিএনপির নেত্রীকে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া জামিন আদেশ বিবেচনায় নিলে বলা যায়, সরকার চাইলে এর বাস্তবায়ন সম্ভব। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং ঐক্যফ্রন্ট উভয়ের উচিত হবে সব ধরনের অস্পষ্টতা এবং হেঁয়ালি পরিহার করা। যেমন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের দেওয়া সাত দফা দাবির ‘অধিকাংশ’ মানা হয়েছে। নির্দিষ্টভাবে তাঁর কথার প্রতিটি দিক জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। সরকার কোনটি কেন মেনেছে, এবং কোনটি কেন মানতে পারেনি, তা দফাওয়ারি পরিষ্কার করা ভালো। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের তরফে সংবিধানসম্মত একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলা হলেও তারাও কিন্তু তাদের চূড়ান্ত অবস্থান কী, তা পরিষ্কার করেনি। দর-কষাকষির জন্য কৌশলগত কিছু বিষয় ঊহ্য থাকতে পারে, কিন্তু তারও একটা সময়সীমা আছে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

৭ নভেম্বরের আলোচনায় ঐক্যফ্রন্ট প্রধান উপদেষ্টা এবং ১০ জন উপদেষ্টাকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা সরকারি দলের তরফে নাকচ করা হয়েছে। কিন্তু কী বিবেচনায় তারা ১১ জনকে মাথায় রেখে এমন ফর্মুলা দিল, তা স্পষ্ট নয়। ঐক্যফ্রন্টের উচিত হবে, নির্বাচনকালীন সরকার পুনর্গঠনে সংবিধানসম্মত কী কী বিকল্প প্রস্তাব তাদের বিবেচনাধীন রয়েছে, সেসব পরিষ্কার করে বলা।

সংলাপ সফল হওয়ার জন্য যে ধরনের ন্যূনতম রাজনৈতিক বোঝাপড়া দরকার, তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। উভয় পক্ষের মধ্যে শুধু গণভবনে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনা চালানোটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। দুই প্রধান দলেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জ্যেষ্ঠ নেতা রয়েছেন। তাঁরা খোলামন নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

গতকাল দ্বিতীয় দফার আলোচনায় যে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ঘটেনি, তা আমাদের আশাহত করলেও বিস্মিত করেনি। তবে আমরা আশা করব, শেষ পর্যন্ত তারা জনগণকে হারতে দেবে না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেও সংলাপ প্রক্রিয়া যেন থমকে না পড়ে, সেই প্রত্যাশা জনগণের থাকবে। নতুন করে ধরপাকড় বন্ধ রেখে বিএনপির দেওয়া গায়েবি মামলার তালিকা অনুযায়ী যথাবিহিত ব্যবস্থা নিলে তা দ্রুত নির্বাচনবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।