কোপ খান খাসোগি, দাঁও মারেন ইমরান

পকেটের অবস্থা কেরোসিন। তাই টাকার জন্য ইমরান খান ব্যাকুল। তিনি নিজেই বলেছেন, যেকোনো মূল্যে টাকা তাঁর চাই-ই চাই!

ইমরানের হাল দেখে যে–কেউ টিপ্পনী কাটতে পারেন, এমনিতে ভাব কত—আবার টাকার জন্য হাহুতাশ!

পেটে টান পড়লে মানসম্মান ধুয়ে পানি খাবেন ইমরান? তাঁর দারুণ বিপদ। ক্ষমতায় বসতে না বসতেই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ঋণসংকটে পাকিস্তান।

বন্ধু–বান্ধবকে নক করে যাচ্ছিলেন ইমরান। দ্বারে দ্বারে ঘুরে আশা-নিরাশার মাঝে দুলছিলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর কপাল খোলে।

অলরাউন্ডার ইমরান ভালো করেই জানেন, শুধু কপালের জোরেই ‘গোপাল’ আসে না; সময়মতো ঠিক জায়গায় ঠিক বলটাও করতে জানতে হয়।

২২ গজে ইমরান দুর্দান্ত ছিলেন। ক্রিকেটের পর রাজনীতির মাঠেও ভেলকি দেখিয়েছেন। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গোপন সূত্র কাজে লাগিয়ে মসনদে তিনি। কিন্তু হানিমুন করার আগেই তাঁর সংসারে টানাটানি। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার প্রায় ফাঁকা। ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি ধুঁকছে। ব্যালান্স অব পেমেন্টে চলছে ঘাটতি। এ অবস্থায় বিপুল বৈদেশিক সহায়তা ছাড়া পাকিস্তানের বাঁচার আর কোনো উপায় নেই।

সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগি খুনের ঘটনায় ইমরানের কপাল খুলে যায়। সুযোগ বুঝে তিনি ঠিক বলটাই ডেলিভারি দেন। আর ওতেই নিশ্চিত সাফল্য।

গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার পরপরই খাসোগিকে হত্যা করা হয়। তাঁকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। তাঁর লাশ এখনো মেলেনি।

খাসোগির ‘ভ্যানিশ’ হওয়া নিয়ে শুরু থেকেই মিথ্যার বেসাতি করে সৌদি আরব। তারা প্রথমে বলে, খাসোগি সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের কিছু পরেই বেরিয়ে যান। কনস্যুলেটের ভেতরেই খাসোগি খুন হয়েছেন বলে তুর্কি গণমাধ্যম বোমা ফাটায়। এবার সৌদি তার অবস্থান বদল করে বলে, খাসোগি হাতাহাতিতে নিহত হন। আরও পরে রিয়াদ স্বীকার করে, খাসোগি খুন হয়েছেন। তুরস্ক অকাট্য তথ্য-প্রমাণ হাজির করলে সৌদি আরব মেনে নেয় যে খাসোগিকে পূর্বপরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে।

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কট্টর সমালোচক ছিলেন খাসোগি। প্রাণে বাঁচতে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। তবে সমালোচনাটা জারি রেখেছিলেন এই সাংবাদিক। শুধু এই কারণেই যে তাঁকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

খাসোগি হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে সবার মুখে এক নাম—যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি এখন ন্যাকা সাজছেন। কিন্তু এ কথা তো সত্য, তিনিই এখন সৌদি আরবের হর্তাকর্তা। তাঁর আদেশ ছাড়া এই কাজ কে করবেন? কার ঘাড়ে দুটি মাথা আছে?

সৌদি আরব ভেবেছিল, সহজেই ধামাচাপা দেওয়া যাবে। কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারবে না। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তারা যে বোকার স্বর্গে বাস করছে, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

এক খাসোগির মুখ বন্ধ করতে গিয়ে ভালোই ফেঁসেছে সৌদি আরব। খাসোগি খুনের ঘটনায় সৌদি আরবের মুখোশ সবার সামনে খুলে গেছে। এই ঘটনায় রিয়াদ রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে তাদের কোনো কথাই এখন আর বিশ্ববাসী বিশ্বাস করে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে খাসোগি হত্যার মূল্য গুনছে সৌদি আরব।

খাসোগি হত্যার জেরে সৌদি আরব চারদিক থেকে চরম চাপে পড়ে। গত মাসের শেষ দিকে রিয়াদে যুবরাজ সালমান আয়োজিত বহুল আলোচিত ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্মেলন প্রায় লাটে উঠতে বসছিল। সম্মেলন বর্জনের হিড়িক পড়ে। একে একে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতারা।

এই ঘোর বিপদে যুবরাজ সালমান অপার হয়ে বন্ধু খুঁজছিলেন। বন্ধুদের কাছ থেকে সমর্থন চাইছিলেন। টাকার কষ্টে দিনপাত করতে থাকা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান এই সুযোগই নিলেন। খাসোগি খুনের বিষয়ে ইমরান উটপাখির নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন। নীতিনৈতিকতা বাক্সবন্দী করে তিনি সোজা সৌদি আরব ছুটে গেলেন।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে প্রথমবার সৌদি আরব গিয়েছিলেন ইমরান। কিন্তু তখন শিকে ছেঁড়েনি। তবে এবার পাকিস্তানি বুদ্ধি কাজ দেয়। চাওয়ার চেয়ে বেশি সহায়তা পেয়ে যান তিনি।

ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্মেলন চলাকালে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। সমঝোতা অনুযায়ী, সৌদি আরবের কাছ থেকে ৬০০ কোটি ডলারের সহায়তা পাবে পাকিস্তান।

চতুর ইমরানের কূটনৈতিক কৌশলে তাঁর অনুসারীরা বেজায় খুশি। তবে মানবাধিকারকর্মীরা তাঁর সমালোচনা করছেন। তাঁরা বলছেন, ইমরান টাকার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানকে বিবেকবর্জিত একটি লোভী দেশ হিসেবে পরিচিত করেছেন। এই টাকার জন্য পাকিস্তানকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]