সৌদি ঋণ কি ইমরানের কৃতিত্ব?

ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স
ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স

সৌদি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যায় কলঙ্কিত সৌদি আরবের কাছ থেকে ৬০০ কোটি ডলারের ঋণ নিতে দেশটিতে ছুটে গিয়েছিলেন দেনায় নাক পর্যন্ত ডুবে থাকা

পাকিস্তানের নেতা ইমরান খান। ২২ বছর ধরে রাজনীতিতে থাকা ইমরান আগন্তুক নন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ‘নির্বাচিত’, আবার সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদধন্য।

গত আগস্টে ইমরানের প্রথম বেতার ভাষণে দেওয়া কিছু তথ্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলার আর মোট ঋণের বোঝা ২৮ হাজার বিলিয়ন রুপি, বৈদেশিক ঋণ ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে এমন ভয়াবহ ঋণগহ্বর তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানের ২০০৭ সালের আগের ৬০ বছরের ইতিহাসে ঋণের অঙ্কটা ছিল মাত্র ৬ হাজার বিলিয়ন রুপি।

১০ বছরে ‘গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকার’ ঋণের বোঝা প্রায় পাঁচ গুণ যে বাড়াতে পারে, পাকিস্তান তার উদাহরণ। এ তথ্য দিয়ে ইমরান জানিয়েছিলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপিপি পাকিস্তানকে ভিখারি করলেও প্রধানমন্ত্রী বিরাট লটবহর নিয়ে উন্নয়নের গীত গাইতে গাইতে মহাসমারোহে বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। নিরাপত্তা সংবেদী পিপিপি প্রধানমন্ত্রীর ছিল ৫২৪ লোকবল, ৩০টি বুলেটপ্রুফ গাড়ি, ৮০টি বিলাসবহুল গাড়ি; তাঁর শুধু বিদেশভ্রমণের খরচ ৬৫ কোটি রুপি।

আমলাতন্ত্রের আবরু রক্ষার ঐতিহ্যও ভেঙেছেন ইমরান। বলেছেন, ব্রিটিশ প্রভুরা বিদায় নিলেও সেই ধ্যানধারণায় বুঁদ সচিব-ডিসিরা। আলিশান বাংলো ছাড়া নিদ আসে না তাঁদের। ১০০ সচিবের দু-তিনটি করে গাড়ি। অথচ ৪৫ শতাংশ পাকিস্তানি শিশু অপুষ্টির শিকার, মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি।

ইমরান তাঁর প্রথম বক্তৃতায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনকে বিশ্ববিদ্যালয় করবেন। আর নিজে থাকবেন সামরিক সচিবের তিন বেডরুমের বাড়িতে। তা তিনি থাকুন, কিন্তু পাকিস্তানের মিলিটারি বিজনেস নিয়ে তিনি একেবারে চুপ। সামরিক বাহিনীর তহবিলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অর্থ ঢালা বন্ধ করায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় বেশ সরব।

তবে রাজনীতিতে আইএসআইয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করবেন কি না, সে বিষয়ে নীরব তিনি। বরং দুই প্রধান বিরোধী দলকে হুঁশিয়ার করেছেন এই বলে যে ৩ লাখ কোটি রুপি ঋণের বোঝা কী করে হলো, সে অর্থ কোথায় গেল, তা তিনি নিরীক্ষা করাবেন। আওড়ে যাচ্ছেন সেই অন্তঃসারশূন্য বুলি—দুর্নীতিবাজ কেউ পার পাবে না।

সৌদি ও অন্য বৃহৎ দাতারা কেউ পাকিস্তানের উল্লিখিত অভ্যন্তরীণ অবস্থা বদলে দেবে না। আসিফ জারদারি ৭ নভেম্বর ‘ভিক্ষাবৃত্তির’ জন্য নিন্দা করলেও তিনিও ইমরানের পূর্বসূরি, ঋণং ঘৃতং পীবেৎ সমর্থক। ইমরান নিশ্চিত জানতেন, বড় দুঃসময়ে ছাতা ধরার সুফল কী। যখন সৌদি রাজতন্ত্রের হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত, তখন তাদের দুয়ারে ভিক্ষার ঝুলি হাতে ছুটে গেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন। যখন অনেক বিবেকি সরকারপ্রধান মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন, সবার অলক্ষ্যে ৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বিনিময়ে পাকিস্তানের ২০ কোটি মানুষের মর্যাদা বিকিয়ে দিয়েছেন ইমরান খান।

অথচ কী শর্তে তিনি ঋণ নিয়েছেন, সেসব তথ্যও দেশের মানুষকে জানালেন না। দেশে ফেরার এক দিন পরে দর্পভরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণপ্রাপ্তির তথ্য ঘোষণা করেন ইমরান। খাসোগি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ইমরান জাতিকে কিছু বলেননি। শুধু লন্ডনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকাকে ইমরান অবশ্য ক্ষীণস্বরে তাঁর ভালো না লাগার ভাবটা প্রকাশ করেছেন।

ইমরান আসলে ‘ঋণ জয়’ করেননি বরং সৌদি রাজতন্ত্রের যূপকাষ্ঠে পাকিস্তানি নিরীহ জনগণের ভাবমূর্তি বলি দিয়েছেন। ইমরান ইয়েমেনের সঙ্গে বিবাদ মেটাতে ‘মধ্যস্থতা’ করার প্রস্তাব দেওয়ার পরে জল্পনা হলো, পাকিস্তানি সেনারা হয়তো সৌদির হয়ে ভাড়া খাটবে। তবে ঋণ শর্তযুক্ত না থাকার দাবি করেও পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী উমর যেটা বলেছেন, সেটা খাসা। তাঁর কথায়, ‘এটা হলো উভয় দেশের জনগণের মধ্যকার যোগাযোগ। আমাদের দরকারে তাঁরা, তাঁদের দরকারে আমরা পাশে থাকি। তাঁরা জানেন, তাঁদের দরকারের সময় আমাদের তাঁরা পাশে পান।’

১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষার পর দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তখন সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের উপহার নিয়ে হাজির হয়েছিল সৌদি আরব। আবার ২০১৪ সালে কঠিন অর্থসংকটে পড়লে নওয়াজের পাশে ‘দেড় বিলিয়ন ডলারের’ উপহার হাতে ঠিকই দাঁড়ায় সৌদি রাজপরিবার। ইমরান সৌদি আরব থেকে যা পেলেন তা তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নয়। এটা স্রেফ আনুগত্যের নজরানা।

রিয়াদ ও ইসলামাবাদের অন্দরমহলের এই বোঝাপড়ার সঙ্গে জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। আর পাকিস্তানের মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিও আকস্মিক কোনো দৈবদুর্বিপাকের ফল নয়।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক