তথ্য ও গণতন্ত্র

তথ্যের অবাধ প্রবাহের সঙ্গে গণতন্ত্রের নিবিড় সম্পর্ক একটি সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। কার্যকর ও ফলপ্রসূ গণতন্ত্রের জন্য অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যবিনিময়–ব্যবস্থার অভূতপূর্ব অগ্রগতি সত্ত্বেও তথ্যপ্রবাহ অবাধ হয়নি; বরং রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন অংশের পক্ষ থেকে নানা রকমের বাধা আসছে। এই সমস্যা কমবেশি বৈশ্বিক; যেসব মানুষ পৃথিবী, বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, তাঁরা এটাকে পুরো মানবজাতির সমস্যা হিসেবে দেখছেন।

‘ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি কমিশন’ নামে নতুন গঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এই সমস্যাটির প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে আছেন অমর্ত্য সেন, জোসেফ স্টিগলিৎস, মারিও ভার্গাস য়োসা, শিরিন এবাদির মতো নোবেল পুরস্কার বিজয়ীসহ ১৮টি দেশের ২৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ গ্রহণের ৭০তম বর্ষপূর্তির মুহূর্তে তাঁরা তথ্য ও গণতন্ত্র বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক ঘোষণা (ইন্টারন্যাশনাল ডিক্লারেশন অন ইনফরমেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি) প্রকাশ করেছেন। এই ঘোষণায় বৈশ্বিক তথ্য ও যোগাযোগ পরিসরের (গ্লোবাল ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্পেস) জন্য কিছু মৌলিক নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রথমত বলা হচ্ছে বৈশ্বিক তথ্য ও যোগাযোগ পরিসর হলো সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য ব্যবহার্য একটি ব্যবস্থা, যার সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে এই সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে? ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি কমিশনের ঘোষণায় যেসব মূল নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রাইট টু ইনফরমেশন বা সবার তথ্য জানার অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি, দায়িত্বশীলতা, ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, রাজনৈতিক, ভাবাদর্শিক ও ধর্মীয় পক্ষপাতহীনতা, বহুত্ববাদ, তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা ইত্যাদি।

রাইট টু ইনফরমেশন বা সবার তথ্য জানার অধিকার। চিন্তা, ভাব ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্যের অবাধ প্রবাহ; কেননা চিন্তার চর্চা, ভাবের আদান–প্রদান ও মতামত গঠিত হয় তথ্যের ভিত্তিতেই। তাই তথ্যের অবাধ প্রবাহের পথে বিদ্যমান সব বাধা দূর করতে হবে, সব মানুষের জন্য সঠিক তথ্য সহজলভ্য করতে হবে। ১১ নভেম্বর শুরু হবে প্যারিস পিস ফোরাম। এর প্রাক্কালে ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি কমিশন বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি তথ্য ও গণতন্ত্র বিষয়ে অঙ্গীকার গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এই সংগঠনের ১০ জন সদস্য ৬ নভেম্বর একটি যৌথ নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন, যেটিতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সংবাদমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, তথ্য ও সংবাদের ওপর ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল ও করপোরেট জগতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক তথ্যবিকৃতি ইত্যাদি সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

এসব সমস্যা বাংলাদেশেও প্রকটভাবে দৃশ্যমান। বিশেষত তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, ভাব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি কমিশন যে বৈশ্বিক তথ্য ও যোগাযোগ পরিসরকে পুরো মানবজাতির কল্যাণ সাধনের স্থান হিসেবে অভিহিত করে এর সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে, আমাদের দেশে তার বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথমে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন এবং তারপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অত্যন্ত কঠোর কিছু বিধান করার ফলে অনলাইন গণমাধ্যমে নাগরিকদের স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দভাবে তথ্য, ভাব ও মতামত বিনিময় এবং পেশাদার সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একটা বৈরী ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

এসবের ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে হবে; গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি হয় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।