একজন কর্মী-লেখকের চোখে

বাংলাদেশের সংবাদপত্রজগতে নতুন হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল আজকের কাগজ। তখন বলাবলি হতো, এটি এমন একটি দৈনিক, যার সব কটি পাতা পড়া যায়। সে তুলনায় অন্য চালু পত্রিকাগুলো কেমন যেন পানসে মনে হতো। কিন্তু মালিক যদি নিজেই পত্রিকার অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন, আর তিনি যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে পত্রিকা আর পত্রিকা থাকে না। আজকের কাগজ এভাবেই তার আবেদন হারাল।

প্রায় একই আঙ্গিকে তখন বের হলো ভোরের কাগজ। পাঠকপ্রিয় হতে দেরি হলো না। ওখানে তখন বার্তা সম্পাদক সোহরাব হাসান। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী। তাঁর মাধ্যমেই যোগাযোগ এবং পরিচয় হলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে। পিজি হাসপাতালের পাশের গলি দিয়ে ভেতরে যাওয়ার পথে একটা ভাড়াবাড়িতে এক সন্ধ্যায় দেখলাম, সম্পাদক নিজেই নিউজপ্রিন্টের ভারী ভারী বান্ডিল টানাটানি করছেন। মস্কোপন্থীদের ব্যাপারে আমার একটু অ্যালার্জি আছে। হয়তো তাঁদেরও অ্যালার্জি আছে আমাদের ঘরানার লেখকদের সম্পর্কে। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই মনে হলো, আমরা পরস্পরকে পছন্দ করে ফেললাম। শুরু করলাম অনিয়মিত কলাম লেখা।

১৯৯৫ সালে নাগরিক সমাজের একটা ফোরামে অংশ নিতে গিয়েছিলাম কাঠমান্ডু। নেপালের প্রধানমন্ত্রী তখন মনমোহন অধিকারী। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং এই মহাদেশের প্রথম নির্বাচিত কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী। আমি তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। পরে এটা ভোরের কাগজ-এ ছাপা হয়েছিল প্রথম পাতায়। কিছুদিন পর কোপেনহেগেনে গেলাম সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে আয়োজিত জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনে। সম্পাদক আমাকে চটজলদি একটা পরিচয়পত্র বানিয়ে দিলেন। বললেন, সম্ভব হলে প্রতিদিন একটা ডেসপ্যাচ পাঠাবেন, আমরা ছাপব। তো সেইমতো আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটা করে প্রতিবেদন পাঠাতাম। সারা দিনের কাজকর্মের সারাংশ হাতে লিখে ফ্যাক্স করতাম। ওটা পরদিন ভোরের কাগজ-এর প্রথম বা শেষ পাতায় ছাপা হতো আমার নামেই। ফিরে এসেও কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম।

যে সংকটে পড়ে আজকের কাগজ আবেদন হারিয়েছিল, ভোরের কাগজও তেমন সংকটে পড়ল কয়েক বছর পর। সম্পাদক দলবল নিয়ে বের হয়ে গেলেন। প্রকাশ করলেন প্রথম আলো। ছাপা হওয়ার আগে এর ভালো প্রচার হয়েছিল। শিরোনামটি চেনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস পড়েছিলাম দেশ ম্যাগাজিনে। এ নামে একটা দৈনিক পত্রিকা বের হতে পারে, কখনো ভাবিনি। তো শুরুতেই কাগজটি বাজার মাত করল। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে।

প্রথম আলোয় আমার অনিয়মিত কলাম লেখা শুরু হয় বেশ দেরিতে। ২০১০ সালের কথা। তখন একটা সভা উপলক্ষে আমি দিল্লিতে। ঠিক ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই শহরে। দিল্লির কাগজগুলোয় বাংলাদেশের সংবাদ খুব একটা থাকে না। একটা কথা চালু আছে বাজারে। ওয়াশিংটন দিল্লিকে যে চোখে দেখে, দিল্লিও ঢাকাকে একই চোখে দেখে। ঢাকায় ফিরে এসে আমি প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর নিয়ে একটি কলাম লিখি। তারপর মাঝেমধ্যেই লিখতাম। সম্পাদক উৎসাহ দেন, অনুরোধ করেন সপ্তাহে একটা কলাম যেন লিখি। সব সপ্তাহে হয়ে ওঠে না। আমার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বার ঠিক করা নেই। কখনো নিজে থেকে লিখে পাঠিয়ে দিই, কখনোবা অনুরোধ পেয়ে লিখি।

এর আগে আমি ইংরেজি দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলোতে লিখতাম। একসময় প্রচুর লিখছি। পরে বুঝলাম, ইংরেজিতে লিখে পাঠকের কাছে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। প্রথম আলোয় লেখালেখির কারণে এখন আমাকে অনেকেই চেনেন, জানেন। কারণ, এর পাঠকসংখ্যা প্রচুর। এখানে লিখে আমি তৃপ্তি পাই। প্রথম আলোয় যেদিন লেখা পাঠানো শুরু করলাম, তারপর থেকে অন্য কোনো প‌ত্রিকায় সরাসরি লিখিনি।

প্রথম আলো শুধু বহুল পঠিত পত্রিকা নয়, এটি বহুল আলোচিতও বটে। প্রথম আলোর রেফারেন্স ঘেঁটে অনেকেই উদ্ধৃতি দেন, আবার সমালোচনা ও গালমন্দও করেন। এর পেছনে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি আছে প্রেজুডিস বা অ্যালার্জি।

প্রথম আলো মুক্তচিন্তাকে প্রণোদনা দেয়। যদিও এর নিজস্ব একটি সম্পাদকীয় নীতি আছে, তবু তার বিপরীতে গিয়ে যুক্তিসংগত লেখা দিলে তারা ছাপায়। এ ব্যাপারে আমার নিজের অভিজ্ঞতা মন্দ নয়। তখন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। পানি জাতীয়তাবাদ বেশ তুঙ্গে। তো আমি এ নিয়ে একটি কলাম লিখে পাঠালাম। লেখাটি পড়লে মনে হতে পারে আমি বুঝি এই বাঁধের পক্ষে। আমার যুক্তি ছিল, বাঁধটি ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে, এটা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। বরং বিদ্যমান তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলা যায়, এই বাঁধে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। আমার লেখাটি দুই মাস আটকে থাকার পর ছাপা হলো। মনে হলো ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়েছে। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ১১০টি মন্তব্য পেলাম। এর মধ্যে ১০০টিই সমালোচনা ও গালাগাল। আমার ব্যক্তিগত ই-মেইলেও পেলাম শতাধিক মন্তব্য, ৯০ শতাংশই গালাগাল। মুশকিল হলো কোনো পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ আমার সমালোচনা করেননি। সমালোচনা ছিল প্রধানত রাজনৈতিক। এরপর এদিকে ব্যালান্স করার জন্যই হোক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, আমাকে সমালোচনা করে লেখা চারটি কলাম ছাপা হলো এর পরপর। আমি ওই মন্তব্যগুলো আমার কম্পিউটারে রেখে দিয়েছি।

ইতিমধ্যে প্রথমা প্রকাশন থেকে রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে লেখা আমার কয়েকটি বই বেরিয়েছে। ফলে নামটা আরও চাউর হয়েছে। একদিন অফিসে বসে কথাবার্তা হচ্ছিল। কেউ একজন বললেন, আমি তো খুব খাটাখাটি করে লিখি। সম্পাদক মন্তব্য করলেন, ‘মহিউদ্দিন হলো কর্মী-লেখক।’ একজন প্রশ্ন করলেন, আপনি কেমন সম্পাদক? সম্পাদক অবলীলায় বললেন, ‘আমি কর্মী-সম্পাদক।’ তাঁর এই শব্দচয়ন আমার কাছে যথার্থ মনে হয়েছে।

অনেক সম্পাদক দেখি সন্ধ্যার পর টক শো করে বেড়ান। তাঁরা পত্রিকার কাজ দেখেন কখন? প্রথম আলোর সম্পাদককে দেখি মধ্যরাত পর্যন্ত অফিসে বসে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, সংবাদের শিরোনাম ঠিক করে দেন, বিরক্ত হয়ে কাউকে কাউকে ধমক দেন। তিনি কাগজটিকে দেখেন নিজের সন্তানের মতো। আমার মনে হয়, কেউ যদি তাঁকে খুন করতে চায়, তাহলে প্রথম আলো থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলেই তিনি কামিয়াব হবেন।

আমি একটু-আধটু গবেষণা-টবেষণা করি। তথ্য-উপাত্তের ব্যাপারে আমার শুচিবাই প্রবল। ভুলচুক হলে আমার সহ্য হয় না। প্রথম আলোয় মাঝেমধ্যে ভুল তথ্য দেখি। আমার এটা ভালো লাগে না। হয়তো আরেকটু যত্নশীল হলে অনেক ভুল বা ত্রুটি এড়ানো যেত। পত্রিকায় কী ছাপা হবে আর কী থাকবে না, তার সিদ্ধান্ত নেন সম্পাদক। সব পাঠকের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। অনেককেই অনুযোগ করতে দেখি, প্রথম আলোর মতো কাগজে এসব ছাইপাঁশ ছাপা হয় কেন?

আমার কাছে এর একটি সরল জবাব আছে। যা ভালো লাগে, তা পড়ব। যা ভালো লাগে না, তা উপেক্ষা করব। আমার টেন্ডার নোটিশ পড়তে ভালো লাগে না। অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা ওটা ছাড়া অন্য কিছু পড়েন না। এই পত্রিকা হলো অনেকটা বুফে খাবারের মতো। আইটেম আছে হয়তো ১০০টি। আমাদের অনেকের স্বভাব হলো সব আইটেম চেখে দেখতে না পারলে মনে হয় লস হয়ে গেল।

পত্রিকাটির কলেবর অনেক বেড়েছে। কাগজের পরিধি যেমন বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটিও পেয়েছে করপোরেট চরিত্র। এ ধরনের পরিবর্তন বা বিবর্তনের ফলে পেশাদারত্ব যেমন বাড়ে, তেমনি বেড়ে যায় দায়সারা কাজের প্রবণতা। আমি চাই প্রথম আলো হয়ে উঠুক আরও ত্রুটিমুক্ত। আমি চাই আমার পছন্দের কাগজ হবে সবার সেরা, সর্বাঙ্গ সুন্দর।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক