'বিচ্ছিন্ন' রাজশাহী

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তথা জনগণের জানমাল হেফাজত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সেই জানমাল রক্ষার দোহাই দিয়ে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের চলাচলে বাধা দিতে পারে না। সংবিধান অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু রাজশাহীতে শুক্রবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা করেছে, সেটি যেমন আইনবিরুদ্ধ, তেমনি নাগরিক অধিকার হরণের শামিল।

সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, জনসমাবেশে আগত লোকজনকে তারা পদে পদে হয়রানি করেছে, তল্লাশির নামে গন্তব্যে যেতে বাধা দিয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যেসব খোঁড়া যুক্তি দিয়েছেন, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এর আগে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশকে কেন্দ্র করেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একই কাজ করেছে।

তবে রাজশাহীর সমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই বাড়াবাড়ির পাশাপাশি পরিবহনশ্রমিকেরা কথিত ধর্মঘটের নামে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে রাজশাহীকে দুই দিন প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল বাইরে থেকে যেন শহরে কেউ আসতে না পারে। প্রথমে তাঁরা নাটোরে এক বাসচালককে মারধর করার অজুহাত দেখিয়েছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে মারধর বা লাঞ্ছিত করার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ধর্মঘট নিয়ে পরিবহনশ্রমিক ও মালিকেরা একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। সব মিলিয়ে রাজশাহী অঞ্চলে এক অরাজক অবস্থা তৈরি হয়। এতে কেবল সমাবেশে আগত লোকজনই বাধাগ্রস্ত হয়নি, বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন।

এত দিন গায়েবি মামলা দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাইকারি গ্রেপ্তারের ঘটনার কথা আমরা শুনে এসেছি। এবার গায়েবি মারধরের দোহাই দিয়ে পরিবহন ধর্মঘট পালন করা হলো। সরকার–সমর্থক পরিবহনশ্রমিক সংগঠনই ধর্মঘটের নামে রাজশাহীর জনজীবন অচল করে দিয়েছে, যেই সংগঠনের প্রধান হলেন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। এর আগে সড়ক নিরাপত্তা আইনের প্রতিবাদে তাঁর নেতৃত্বাধীন পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করেছিল। এত বড় বেআইনি কর্মকাণ্ডের পরও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সরকার কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।

আর ধর্মঘটের নামে পরিবহন শ্রমিক সংগঠন এসব বেআইনি ও জবরদস্তি কর্মকাণ্ড এমন সময় ঘটিয়েছে, যখন সংলাপে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে কোনো ধরনের বাধা না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারে সব দল সমান সুযোগ পাবে। এটাই কি সেই সমান সুযোগের নমুনা? সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক তফসিল ঘোষণার পর সমাবেশকে অবৈধ বলে অভিহিত করেছেন। সমাবেশ যদি অবৈধই হয়, তাহলে সরকার সেটি বন্ধের জন্য নির্দেশনা জারি করল না কেন? আর তফসিলের পর এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র নির্বাচন কমিশনের; মন্ত্রী বা সরকারি দলের কোনো নেতার নয়।

যখন সরকার সমাবেশ করার অনুমতিই দিয়েছে, তখন সেই সমাবেশে আগত লোকজনকে বাধা দেওয়া বেআইনি এবং ধর্মঘটের নামে জনজীবন অচল করা সংঘবদ্ধ মাস্তানি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পুলিশের বাধা, তথাকথিত শ্রমিক সংগঠনের বল প্রয়োগ ও নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়ার পরও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা ট্রেন, ভ্যান, মাইক্রোবাস এমনকি দীর্ঘ পথ হেঁটেও সেখানে এসেছেন।

তাহলে সরকার কেন এই অপকৌশল নিল? কেন বারবার পরিবহন ধর্মঘটের নামে জনগণকে সীমাহীন দুর্ভোগে ফেলা? একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইলে এমন অপকৌশল থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।