'আপনি ইলেকশনের কতা কচ্চেন?'

সিরাজগঞ্জের যমুনার চর তেঘরিয়ায় হালিমা খাতুনের বাড়র আঙিনায় সাইনবোর্ড শোভিত সব্জি বাগান। ছবি: লেখক
সিরাজগঞ্জের যমুনার চর তেঘরিয়ায় হালিমা খাতুনের বাড়র আঙিনায় সাইনবোর্ড শোভিত সব্জি বাগান। ছবি: লেখক

গ্রামের ছেলেমেয়েরা হাইস্কুলে যাচ্ছে। হোঁচট খেলাম তাদের একটা দলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। ২৪ জনের কেউই বলতে পারল না রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নাম। ইচ্ছা ছিল রাষ্ট্রপতির রসিকতার গলি ধরে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা জমাব। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়ল। দেশের গদিনশিন রাষ্ট্রপতির নাম জানা না-জানা দিয়ে কোনো কিছু মাপা যায় না। তারপরও একজনও জানবে না, তা কী করে হয়? ওদের একজনও এবার ভোটার না। সামনের ভোটে তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে না বলায় হেসে ফেলে কয়জন। বলে, ভোটার লিস্টে নাম না থাকলেও ভোটের কাজ করা যায়। ভোটকেন্দ্রে যাওয়া যায়, এমনকি ভোটও দেওয়া যায়। শুধু দরকার একটা মার্কা। সে রকম মার্কা বুকে সাঁটা থাকলে কে কাকে ঠেকায়?

কার্তিকের যমুনা তখন শুকিয়ে কাঠ, আরও শুকাবে। গেল শ্রাবণের শেষে যমুনা সেতুর পাশে পুর্নবাসনের ঘাট থেকে নৌকায় যে চরে দু-আড়াই ঘণ্টায় যাওয়া যেত, এখন সেখানে লাগে চার-পাঁচ ঘণ্টা। দু-তিন ঘণ্টার শ্যালো নৌকায়, তারপর হাঁটা বা খেতের আইল এবং মোটরবাইকে। জায়গাটা চৌহালী উপজেলার ঘোরজান ইউনিয়নের তেঘোরি গ্রাম। সেখানে পরিবর্তন বেশ ‘দৃশ্যমান’। দেশের এক কারবারি প্রতিষ্ঠান এই দুর্গম চরের মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিচ্ছে। সোলার প্যানেল বসিয়ে বাড়ি বাড়ি সংযোগ দিচ্ছে। বাজারটাও বেশ জমজমাট, রাত অবধি মানুষের আনাগোনা। কেক পাওয়া যায় চায়ের দোকানে। চাষের মুরগি, চাষের মাছ গ্রাসকাপ সহজেই মেলে। হাটবারের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় না। ভারত থেকে আসা কারবারি কনসালট্যান্টরা বানের দেশের চরের মানুষদের শেখাচ্ছে বানের সঙ্গে বসবাসের তরিকা। জানা জিনিস নতুন মোড়কে বাজারজাত হচ্ছে।

ছেলেরা নদী পেরিয়ে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে যায় পড়তে, মেয়েরা চরেরই স্কুলে। দু-একজন কলেজেও যাচ্ছে। কাকডাকা ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে বাজারে চায়ের দোকানের জটলায় দেখি খদ্দেররা ডিশ টিভিতে মশগুল। খবর দেখছে ঢাকার। এখানে এখন আর কেউ আর হুলিয়া মাথায় করে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা ছাত্রটির কাছে রাজধানীর খবর শোনার জন্য ছুটে আসে না। নির্মলেন্দু গ‌ুণের ‘হুলিয়া’ কবিতার ‘ন্যাপকর্মী ইয়াসিন’, ‘রসুলপুরের অদিত্য’, ‘আমতলার আব্বাস’—কেউ আর নেই। কবিদের কতজন এখন পদক গায়ে মঞ্চে বসে জিরা-পানি পান করেন! চায়ের দোকানে বসলেই ডিশ টিভি সব বলে দেয়। চুপচাপ বসে থাকা মালেক মিয়ার মুখে কথা ফোটে, ‘না না, সবটা কয় না, বুঝে নিবার লাগে বাকিটা।’

এক চোখে ছানি নিয়ে টিভি দেখেন মালেক মিয়া। অন্য চোখের ছানি কাটা হলেও ঝাপসা ভাবটা কাটেনি। চক্ষুশিবিরের ডাক্তারের হয়তো তাড়া ছিল। মালেক বলেন, ফ্রি কোনো কিছুই ভালো হয় না। চোখ বন্ধ করেই টিভি দেখেন মালেক। শুনতে পান সবটাই। খবর রাখেন সংলাপের, তাঁর ভাষায় ওটা সংলাপ না, সালিস। বলেন, ‘সালিসি করবা নিজের ভিটায়, না হয় অন্য কারও ভিটায় কিংবা বারোয়ারি গাছতলা হাটের মধ্যে করো। তোমার সঙ্গে আমার কাইজ্জা, মতের অমিল, লেনাদেনার হিসাব মেলে না, ভুলে ভরা হিসাবের খাতা। এসবের সুরাহা করতেই তো সালিস-আলাপ-বৈঠক।’

সংলাপের নিয়ম নিয়ে আস্তে আস্তে নিজের কথা বলতে থাকেন তিনি, ‘তাই যার কাছে খাতা, তার বাড়িতে বসে সালিস হয় না। দাওয়াত দিলেও হয় না। হিসাবের খাতাওয়ালার বাড়িতে হিসাব মেলানোর বৈঠকে গিয়েছ তো সব শেষ। খাতা খোলার আগেই তিনি একথা-সেকথা বলবেন, পান-সুপারি সাদা পাতা দিয়ে কোন হাটের পান-সুপারি কেমন স্বাদ, এসব কথা ওঠাবেন। খামাখা সুড়সুড়ি-কাতুকুতু দেবেন। বউ-ছেলে-মেয়ের কথা তুলবেন। টীকা–টিপ্পনী কেটে তোমার মেজাজের বারোটা বাজাবে। তোমাকে এসব সহ্য করে হে হে করতে হবে, কারণ আলাপের ভিটাটা তার আর তুমি “অন্যের ভিটা”য়। আসল কথা, যাওয়ার আগেই বেলা শেষ হয়ে যাবে, তারপর আবার দিনক্ষণ ঠিক করা লাগবে।’

ভাষা মতিনের বাড়ি ছিল এই চৌহালীতে—এখনকার মানুষ এখনো তাঁকে ছাত্র মতিন বলে। ছাত্র মতিনের সঙ্গে মালেক মিয়ার বয়সের তফাত ১০–১২ বছরের কম নয়। হুলিয়া মাথায় করে অনেকবার চৌহালীর নানা চরে আশ্রয় নিয়েছেন ভাষা মতিন। তখন মুরাদপুর ঘাট ছিল, এখন সেসব নদীর তলায়। মুরাদপুর ঘাট থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকায় অনেকবার ছাত্র মতিনকে এদিক–সেদিক নিয়ে গেছেন তখনকার কিশোর মালেক। শহরের শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে মালেকের যোগাযোগ এটুকুই।

স্কুলে যাননি লোকটা। শহর বলতে শুধু দেখেছেন সিরাজগঞ্জ আর টাঙ্গাইল। সত্তর পার করা এই মানুষ সংলাপ, সালিস, বৈঠক সম্পর্কে এমন সহজ বিশ্লেষণ দেন কীভাবে? কীভাবে আগাম বলে দেন সংলাপের ভবিষ্যৎ। বলেন, ‘একটা কেতাবই পড়েছি জীবনে, সে কেতাবের নাম জীবনকেতাব। ওটা পড়তে চশমা লাগে না। জজ–ব্যারিস্টার হতে হয় না। ফল না পাকতে দিলে তার বীজে গাছ হয় না। তোমারা বিছন (বীজ) নষ্ট কোরো না।’এই মারফতি কথার মর্ম বোঝার সাধ্য নেই। সন্ধ্যা নেমে আসে, পা চালিয়ে ঘাটের দিকে যাই। নৌকা থেকে দূরে কয়েক কিশোরের জটলা, মাঝি তেল ঢালে ইঞ্জিনে। এই ফাঁকে কিশোরদের সঙ্গে একটু খেজুরে আলাপ।

জিজ্ঞাসা করি, ‘ভোট কবে?’
একজনের উত্তর: ভোট তো হয়ে গেছে কবেই।
না মানে জাতীয় নির্বাচনের কথা শোনো নাই?
: ও, আপনে ইলেকশনের কথা কচ্চেন?

মাঝি তাড়া দেন। আমরাও নৌকায় উঠে পড়ি।

ইউনিয়ন পরিষদের ভোট আর সংসদ নির্বাচনের কথা ভাবি। ভাবি, সংলাপ, রাজনৈতিক ক্ষমতা, নির্বাচনের সঙ্গে কী সম্পর্ক এসব কথার: ‘ফল না পাকতে দিলে তার বীজে গাছ হয় না। তোমারা বিছন (বীজ) নষ্ট কোরো না।’

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা কর্মী।