লেফটেন্যান্ট কলম্বোর ভূমিকায় এরদোয়ান!

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানে
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানে

বিখ্যাত সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে যে দুটি গোয়েন্দা চরিত্রের কথা সবার আগে মাথায় আসে, তারা হচ্ছে আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস ও আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়ারো। এদের পাশাপাশি আরেকটি নামও এখন উচ্চারিত হয়। আর সেটা হচ্ছে আমেরিকান টেলিভিশন সিরিজ ‘কলম্বো’র প্রধান চরিত্র লেফটেন্যান্ট কলম্বোর নামটি। ‘কলম্বো’ সিরিজে লেফটেন্যান্ট কলম্বো ছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ বিভাগের একজন নরহত্যার তদন্তকারী গোয়েন্দা।

শার্লক হোমসের তদন্তের ধরনটি এমন যে তিনি তা প্রকাশ না করা পর্যন্ত পাঠক আসল অপরাধী কে, তা বুঝতে বা শনাক্ত করতে পারে না। এরকুল পোয়ারোর তদন্তের ধরনে পাঠক অনেককে তাদের সন্দেহের তালিকায় ফেলে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি আসল অপরাধী বা অপরাধীদের তথ্যপ্রমাণসহ ধরেন। কিন্তু লেফটেন্যান্ট কলম্বোর তদন্তের ধরনটি এ দুজনের চেয়ে একেবারেই আলাদা। তিনি এবং আমরা দর্শকেরা সবাই জানি যে আসল হত্যাকারী কে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁকে ধরা যায় না। তখন কলম্বো হত্যাকারীকে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে তাঁকে এমনভাবে ফাঁদে ফেলেন যে শেষ পর্যন্ত হত্যাকারী তাঁর অপরাধের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন।

মনে হয় একই ধরনের ব্যাপার ঘটছে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে। তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে গত ২ অক্টোবর খাসোগিকে হত্যা করা হয়। আমরা সবাই জানি যে সৌদি কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও সৌদি আরব তা স্বীকার করছে না। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, খাসোগিকে খুব নৃশংস উপায়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে, তাঁর মাথা ও হাতের আঙুলগুলো কেটে দেহ থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলা হয়েছে এবং সবশেষে অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়েছে।

খাসোগি হত্যাকাণ্ড খুবই ভয়াবহ এবং জঘন্য। কেন তাঁকে এত নৃশংস উপায়ে হত্যা করা হলো, তা বোঝার জন্য মনে হয় গল্প, সিনেমার সেই গোয়েন্দা চরিত্রগুলোকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

এ ক্ষেত্রে আমরা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে লেফটেন্যান্ট কলম্বোর মিল খুঁজে পাই। কলম্বোর মতো এরদোয়ানও হত্যাকারীকে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করছেন, বিদ্রূপ করছেন এবং তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলছেন।

এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই যে লেফটেন্যান্ট কলম্বোর সঙ্গে এরদোয়ানের তুলনার ফলে তুরস্কের স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে তিনি যে দমন ও ভীতি প্রদর্শনের কর্মসূচি চালু করেছেন, তার অবসান ঘটবে—এমনটি নয়। হ্যাঁ, তিনি হয়তো কোনো সাংবাদিককে টুকরো টুকরো করে হত্যা করার নির্দেশ দেননি, কিন্তু রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের তথ্য অনুযায়ী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক সূচকে তুরস্কের অবস্থান ১৫৭তম।

খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এক মাস ধরে আমরা দেখছি কীভাবে এরদোয়ান সৌদি আরবকে অভিযুক্ত করছেন, যেমনটি করতেন লেফটেন্যান্ট কলম্বো। কলম্বো খুনিকে বিদ্রূপ করার পাশাপাশি নানা তথ্যপ্রমাণ তার সামনে হাজির করতেন এবং একপর্যায়ে খুনি বাধ্য হতো তার অপরাধ স্বীকার করতে। এরদোয়ানের মতো আমরা সবাই জানি কে খাসোগির হত্যাকারী, এই হত্যার উদ্দেশ্য কী এবং হত্যাকাণ্ডে কী কী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে এরদোয়ানের এই ধরনের আচরণের ফলে সৌদি আরব একসময় বাধ্য হয়ে খাসোগিকে হত্যা করার কথা স্বীকার করবে?

প্রথমে সৌদি আরব খাসোগির সঙ্গে কোনো কিছু ঘটার কথাই অস্বীকার করেছিল। খোদ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের কয়েক মিনিট পর বা এক ঘণ্টা পর খাসোগি কনস্যুলেট ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু এরদোয়ান বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছেন যে সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিকের ক্ষেত্রে আসলে কী ঘটেছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে যে খাসোগি কনস্যুলেটের ভেতরে নিহত হয়েছেন। তারা এখন বলছে, খাসোগিকে হত্যা করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এক মারামারিতে তিনি নিহত হয়েছেন।

এরদোয়ান ও সৌদি আরবের মধ্যে এখন ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে পূর্ণোদ্যমে। সৌদি আরব হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করলেও তুর্কি গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে, খাসোগিকে প্রথমে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় এবং পরে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করা হয়। সৌদি নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সালাহ মুহাম্মাদ আল-তুউবিগি খাসোগির আঙুল ও মাথা কেটে তাঁর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের এসব খবরে সৌদি আরবের অন্যতম সমর্থক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে এটা ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য ঘটনা।

আমরা জানি, সৌদি আরবে আটক ১৮ জন সন্দেহভাজনের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারীরা রয়েছেন। আমরা এটা জানি যে তাঁরা কারও নির্দেশে তুরস্কে এসে খাসোগিকে হত্যা করেছেন এবং আমরা এ–ও জানি যে সৌদি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এই হত্যার নির্দেশ এসেছে। কিন্তু এই জানাটা যথেষ্ট নয়, চাই উপযুক্ত প্রমাণ। এ জন্য আসলে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন।

সারা বিশ্বের ১০০ জনেরও বেশি লেখক, সাংবাদিক ও শিল্প জাতিসংঘের কাছে সাংবাদিক জামাল খাসোগির অন্তর্ধান ও হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বানকে জাতিসংঘের আমলে নিতে হবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। অনুবাদ: রোকেয়া রহমান

হামিদ দাবাসি: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান স্টাডিজ অ্যান্ড কম্পারেটিভ লিটারেচারের অধ্যাপক