আমি কেন 'মি টু'র প্রলয় চাই

মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে ৫৬ বছর পার করলাম। # মি টুতে একাত্ম না হওয়ার কোনো সুযোগ তো আমার নেই।

তখন আমার বয়স ১০ কি ১১ হবে। শরীরে বদল আসছে, তবে নারীজীবনে প্রবেশের সূচনা তখনো হয়নি। বদল বুঝি কি বুঝি না। নিজের শরীর নিয়ে অস্বস্তি আর লজ্জার অনুভূতির কথা মনে আছে। সে সময় ওই বয়সের শিশুকে যৌনশিক্ষা দেওয়ার কথা কেউ ভাবত না।

সেদিন বুকের কাছে কুঁচির ঘের লাগানো প্রিয় ফ্রকটা পরে কাকুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার মুখে কাকু আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে বেরোলেন। পথে তিনি নিউমার্কেটের মাছবাজারে ঢুকলেন। আমি তাঁর পেছন পেছন হাঁটছি।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা হাত আমার গায়ে থাবা দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকিয়ে ঘাড়ের কাছে যাকে দেখেছিলাম, তার মাথার ঝাঁকাসহ মুখটা এখনো আমার মনে আছে। আমি কিন্তু তখন চিৎকার দিইনি। কাকুর কাছে ছুটে গিয়েছি কিন্তু তাঁকে কিছুই বলতে পারিনি।

সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম, পুরো শরীরটাই যেন মুচড়ে গিয়েছিল, মনটা কুঁকড়ে ছোট হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরেও আমি কাউকে কিছু বলতে পারিনি। ওই জামাটা আর পরতে ঘেন্না হতো। মাছবাজারের ঘোলাটে আলো আর আঁশটে গন্ধের সঙ্গে লোকটার মুখের হাসি আমার মনে গেঁথে গিয়েছে। কিন্তু ওই বয়সে আমার মনের মধ্যে কীভাবে ঢুকে গিয়েছিল এই বোধ যে, এ কথা কাউকে বলা যাবে না?

এরই এক-দুই বছর পরে আমার স্বল্প পরিচিত এক ‘কাকা’র ওপর দায়িত্ব পড়েছিল আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার। তিনি তখন একা থাকতেন।

আমার ভাইসম ছোট্ট একটি ছেলেও ছিল আমাদের সঙ্গে রিকশায়। ‘কাকা’ তাকে তাঁর বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

রিকশায় ‘কাকা’ আমাকে শক্ত করে পাশে ধরে রাখলেন। আমার কাঁধের ওপর দিয়ে তাঁর হাত আমার গায়ে নেমে লেগে ছিল। আমি শুধু ভাবছিলাম কখন বাসায় পৌঁছাব। তিনি আমাকে অনেকবার বলছিলেন তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়ি ঘুরে যেতে। আমি ঘাড় গোঁজ করে বলে গিয়েছি, বাসায় যাব। তিনি আর জোরাজুরি করেননি। আমার অস্বস্তি, ভয় আর খারাপ লাগার কথা সেদিনও আমি কাউকে বলিনি।

এই ‘কাকা’ আজ স্বনামধন্য ব্যক্তি। তাঁর নাম কাগজে পড়লে, কখনো তাঁকে দেখলে বারবার আমার সেই ভয়াবহ রিকশাযাত্রার কথা মনে পড়ে যায়। বড় হতে হতে অনেকবার ঘটনাটি ভেবেছি। আমার ছোট্ট সেই ভাইটির সম্ভাব্য ঝুঁকির কথাও মনে জেগেছে। যৌনপীড়ন প্রসঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে একবার-দুবার ছাড়া ‘কাকা’র পরিচয় কিন্তু আমি প্রকাশ করিনি।

আজও করব না। কেন? ৪৬ বছর আগের সেই ঘটনার কোনো প্রমাণ আমার কাছে তো নেই। ঘটনা নিয়ে টানাহেঁচড়া করলে তিনি বলতে পারেন, আমি ভুল বুঝেছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা, আমার সেই ভাইটির যদি কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, সে না চাইলে আমি তার ক্ষত খুঁচিয়ে দিতে পারি না। ভাইটির সঙ্গে এ নিয়ে আলাপও কখনো করিনি মূলত একই কারণে।

কিন্তু আমি আর কখনো সেই ‘কাকা’ ডাকের মানুষটির ধারেকাছে ঘেঁষিনি। এ লেখা পড়লে তিনি হয়তো নিজেকে চিনতে পারবেন। হয়তো ভয়ও পাবেন।

আমার বয়স যখন ১৪, মা আর বড় খালার সঙ্গে গুলিস্তানে বাসে ওঠার সময় ভিড়ের মধ্যে একটা লোক খুব খারাপভাবে আমার গায়ে হাত দিয়েছিল। সে কথাটাও আমি মা-খালাকে বলিনি। তবে আমি আর বাসে চড়তে চাইতাম না।

আজ ভাবছি, ছোটবেলায় কেন আমি এ অভিজ্ঞতাগুলোর কথা মা-বাবাকে বলতে পারিনি। বয়ঃসন্ধিতে নিজের শরীর তখন আমার কাছে অচেনা হয়ে যাচ্ছে। সবগুলো ব্যাপার বুঝতামও না পুরোপুরি। শরীর, শরীরের ভালো লাগা আর খারাপ লাগা, শরীরের অপমান—সবকিছুই একান্ত নিজস্ব গোপনীয় বলে বোধ হতো। সংকোচ হতো।

আমরা কিন্তু খুব সুরক্ষিত পরিবেশে বড় হয়েছি। মা–বাবা, খালা-মামা-চাচা-ফুফু, ভাইবোনদের নিরাপদ একটা বলয়ে। গভীর ভালোবাসা, বিশ্বাস আর নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে। আমাদের অভিভাবকেরা আমাদের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। আমাদের কথা তাঁরা বিশ্বাস করতেন। আমাদের ওপর তাঁদের আস্থা ছিল। আমি যদি তখন এসব এবং আরও দু-চারটি অস্বস্তির কথা তাঁদের বলতাম, তাঁরা আমার কথাকে নিশ্চয় গুরুত্ব দিতেন। এ ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতেন। আমার এবং আরও অনেকের সুরক্ষা হয়তো নিশ্চিত হতো।

মা–বাবা ছিলেন আমার নিরাপত্তার মূল খুঁটি। বৃহত্তর পরিবারের পরিবেশেও সুরক্ষা ছিল। কিন্তু বড় হওয়ার পর বোনদের একান্ত আলাপে জেনেছি, এই পরিবেশেও মা–বাবার প্রত্যক্ষ নিবিড় চোখের ছায়ায় যারা বড় হয়নি, তাদের ঝুঁকির অভিজ্ঞতা বেশি। এসব কথা কাউকে বলতে পারে, এমন ভাবতেও তাদের কখনো মনে সাহস হয়নি।

নিজের ঘটনাগুলোর প্রভাব আমি কাটিয়ে উঠেছি। আত্মবিশ্বাস আর আত্মশক্তিতে স্থিত হয়েছি। বড় হওয়ার পর আমার সজ্ঞান সম্মতি অথবা আকর্ষণের দোলাচল ছাড়া কেউ আমার শরীরের ওপর জোর খাটাতে পারেনি। অনেকগুলো বছর একা একা সারা দেশ ঘুরে কাজ করেছি। উটকো আপদ কখনো যে আসেনি, তা বলব না। তবে তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সেটার মোকাবিলা করতে পেরেছি।

কিন্তু নিরাপত্তার জোরালো ছায়া যাদের ছিল না, তেমন অনেককে দেখেছি, এমন অভিজ্ঞতা নিজের ওপর বিশ্বাসের জায়গাটিকেই নষ্ট করে দিতে পারে। শিশু বয়সে মুখ ফুটে কথা বলতে যে ভরসা লাগে, বড় বয়সেও তেমন ভরসার জায়গা তৈরি না হলে কথা বলা যায় না। একজন-দুজন করে কথা বলতে থাকলে কথা বলার সাহস তৈরি হয়।

আমার মেয়ের বয়স ১০ হওয়ার আগেই তাকে আমি শরীর এবং শরীরের ভালো-মন্দ লাগা আর ঝুঁকিগুলো চিনতে শেখাতে চেষ্টা করেছি। তাকে আমি নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বন্দী করে বড় করতে চাই না। নিজেকে নিরাপদ রাখার উপায় শেখাতে চেয়েছি। আর খোলাখুলি কথা বলার ভরসা-পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছি।

তারপরও কিন্তু নিজের শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, তার ছোট্ট জীবনের সবগুলো বিপদের কথা সে আমাকে না-ও জানাতে পারে। আর এখানেই আমার ভয়।

আমাদের মেয়ে ও ছেলেশিশুরা যেন নির্ভয়ে এমন অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারে, সেই ক্ষেত্র তৈরি করতে পারাটা আমাদের বড় কাজ। সেই ক্ষেত্রটি তৈরি করার জন্যই আমার কাছে ‘মি টু’ এত গুরুত্বপূর্ণ। এ আন্দোলনে আমি পুরুষকেও পাশে চাই।

তা ছাড়া, জীবনের এসব কদর্য সত্যের উন্মোচন একা মেয়েদের বিষয় না। আমি চাই, পুরুষেরাও এই উন্মোচনে যোগ দিতে সাহসী হোন, নিঃসংকোচ হোন। যৌননিপীড়কেরা শিশু-নারী-পুরুষনির্বিশেষে দুর্বল অবস্থানের ব্যক্তিকে খোঁজে। সমাজব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গি আর পরিস্থিতির কারণে মেয়েরা আজন্ম দুর্বল অবস্থানে। কিন্তু পুরুষেরাও ছোটবেলা আর বড়বেলার অভিজ্ঞতা খুঁজে দেখুন না কেন?

গায়ের জোরে বা অবস্থানের জোরে ঘরে ও বাইরে যৌন হয়রানি-নিপীড়নের ঘটনা যে কত ব্যাপক, এ কথাটা খোলা আলোয় আসা খুব দরকার। এ সত্য অকপটে স্বীকার করা দরকার। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কঠোর নীতিমালা দরকার। কথায় অথবা আচরণে আমাদের কেউ হেনস্তা-নিপীড়ন করলে আমরা যেন উল্টো দোষারোপের ভয় না করে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকারের পথ খুঁজতে পারি। আমাদের যেন অনেক বছর পর কথাগুলো প্রকাশ করে প্রমাণ-অপ্রমাণের ঘোলাজলে নাকানি-চুবানি খেতে না হয়।

এখন পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকজন বাংলাদেশের ‘মি টু’তে অংশ নিয়েছেন। আমি আশাবাদী, তাঁদের দৃষ্টান্ত আরও অনেককে সাহসী করবে। একবার বাঁধ ভেঙে গেলে কথার ঢল নামবে। পূর্ব-সংস্কারের (প্রেজুডিস) বশে কথাগুলো উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আবার কথার তোড়ে স্বার্থান্বেষী, অন্যায্য বা মিথ্যা অভিযোগ ওঠার ঝুঁকিও মনে রাখতে হবে। তবে তেমন কি খুব বেশি হবে?

অভিযুক্ত ব্যক্তির মতোই স্বনামা অভিযোগকারীর মানসম্মান-বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি অবশ্যম্ভাবী। কেচ্ছা, কাদা-ছোড়াছুড়ির শিকার হতে হবে। ভুক্তভোগীর থাকবে ক্ষত খুঁড়ে তোলার যন্ত্রণা। ক্ষেত্রবিশেষে পাল্টা আক্রমণ শুধু কথাতেও আটকে থাকবে না।

অভিযুক্ত ব্যক্তির অবশ্যই আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থাকতে হবে। কেবল ‘মি টু’র পরিসরে বিচার হতে পারে না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণ বা অপ্রমাণ কোনোটারই সুযোগ থাকবে না। সুতরাং শাস্তি বা প্রতিকার অনিশ্চিত হতে পারে।

কিন্তু তাতে কি ‘মি টু’ অর্থহীন চর্চা হয়ে যাবে? এ অপরাধের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে একে অন্যকে সাহসী করে তোলাটাই এ আন্দোলনের বড় অর্জন। গোপনীয়তার ঢাল অপরাধীজনকে সাহসী করে, সুরক্ষা দেয়।

‘মি টু’র প্রলয় অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য হোক। লজ্জা অপরাধীর। অপরাধের শিকার হয়েছি, এটা প্রকাশ করার মধ্যে দোষ-লজ্জা নেই। এই চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গি গড়তে হলে এ প্রলয় লাগবেই। প্রলয়ের পথ ধরে আমি নিঃসংকোচে আমার কথা বলতে সাহসী হব। আমার সাহস আমার সন্তানকে সে কথা শুনতে ও বুঝতে এবং নিজের কথা বলতে সাহসী করবে।

লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় এবং ধর্ম-বর্ণ-জাতি-মতবিশ্বাস নির্বিশেষে সব মানুষকে সমান মূল্য, অধিকার আর মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা শুরু হতে হয় একেবারে শিশুকাল থেকে। নতুন পৃথিবী, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়াটা হচ্ছে গোড়ার কথা। ‘মি টু’র প্রলয় সেটারই একটা পথমাত্র, তার বেশি কিছু না। কমও না।

কুররাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: সাংবাদিক