বহুরূপী ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত গণতন্ত্র

ফ্যাসিজম শব্দটিকে অমরত্ব দিয়েছেন ইতালির লৌহমানব বেনিতো মুসোলিনি। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা দিয়ে মুসোলিনির সঙ্গে আরও অনেক শাসকই নিজেদের যুক্ত করেছেন। জার্মানির হিটলার, স্পেনের ফ্রাংকো, চিলির পিনোচেট বা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো। অথবা লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম, মিসরের হোসনি মোবারক বা হাল আমলে তুরস্ক, ইরান, চীন, মার্কিন বা সৌদি শাসকেরাও কম যান না। জনগণের অধিকার সংকুচিত করা, ভোটাধিকার রহিত করা, বাক্‌স্বাধীনতা হরণ, যখন-তখন জেলে পোরা, রাষ্ট্রীয় মদদে গুম, খুন, অপহরণ—এসব শাসনের নিত্যঘটনা।

নির্মম শাসকদের নিষ্ঠুরতার বিবরণ আমরা ইতিহাসে পাই। প্রাচীনকালেও এই ধরনের শাসক ছিলেন নিশ্চয়ই। মিসরীয় সভ্যতার ফারাওদের যেসব ঘটনার বিবরণ ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়, তা থেকে বোঝা যায়, সাধারণ নাগরিকদের নির্যাতন-অত্যাচার কম করা হয়নি। মেসোপটেমীয় সভ্যতায়ও একই নমুনা পাওয়া যায়। আমরা প্রাচীন সভ্যতাগুলোর শৌর্য–বীর্যের গাথা পাঠ করি। বিত্তবৈভবের গল্প শুনি। কিন্তু এর পেছনে নাগরিকের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই না।

লরেন্স ব্রিট ফ্যাসিজমের ১৪টি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে আলোচনা করেছেন। ব্রিটের আলোচনাকে বিবেচনায় নিলে ফ্যাসিজম শাসকদের এমন এক চরিত্র প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত চারপাশে বিদ্যমান। ফ্যাসিজমের ইতিহাসকে মোটাদাগে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক রাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্র গঠনের সময় পর্যন্ত প্রথম ধাপ। এই ধাপে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য শাসকেরা ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারণ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়কে আরেকটি ধাপে বিবেচনা করা যায়। এ সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের শক্তি অর্জন, দখলকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিস্ট শাসকেরা সক্রিয় ছিলেন। এরপর ফ্যাসিজম ভিন্ন ধারণা নিয়ে আবির্ভূত হয়। নব্য ফ্যাসিস্টরা বলতে শুরু করেন, উন্নয়নের জন্য দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। ফ্যাসিস্ট শাসকেরা সমালোচকদের দেশবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী বলে দমন–নিপীড়ন করেন শক্ত হাতে। তাঁরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের চেয়ে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজনকে উসকে দেন। কারণ, বিভাজিত সমাজকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

এসব রাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে সামনে তুলে ধরে। এই জাতীয়তাবাদ পুঁজিতন্ত্রের ফসল। জাতীয়তাবাদ পশ্চিমের ধারণা। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এই জাতীয়তাবাদী ধারণা থেকে পশ্চিম ইউরোপ বের হয়েছে। এখানেই পশ্চিম ইউরোপ সফল। পশ্চিম ইউরোপে এটা কীভাবে সম্ভব হলো? জাতীয়তাবাদের নামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ফ্যাসিবাদ কায়েমের অভিজ্ঞতা থেকে কোটি প্রাণের বিনিময়ে তারা শিখেছে। প্রকৃতপক্ষে অধিকতর গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো টিকে আছে। অন্তত নাগরিক হিসেবে সমঅধিকার ওই সব রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নিশ্চিত করেছে। তারপরও দেখা যায়, শরণার্থীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ফ্যাসিবাদীরা সেখানেও মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড-হাঙ্গেরিতেও দেখা দিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদের উপসর্গ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচুর্য আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নেও ছিল। চীনেও তা। কিন্তু ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত না। এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার দেশগুলো কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাভিত্তিক শাসনের ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। আধুনিক অনেক রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হচ্ছে নাগরিককে ক্ষমতাহীন করে এরা সর্বসময় ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে নিয়েছে। (পশ্চিম ইউরোপ কিছুটা ব্যতিক্রম এ কারণে যে তারা ফ্যাসিবাদের বীভৎস অভিজ্ঞতার শিক্ষাটা নিতে পেরেছে।) আইনি অর্থে সব নাগরিকের সমান অধিকার দিলেও বাস্তবে তা নেই। এখানে যিনিই ক্ষমতায় যান, তিনিই ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারণ করেন। রাশিয়ার নৈরাষ্ট্রবাদী বিপ্লবী মিখাইল বুকানিন বলেছিলেন, ভালো লোক ক্ষমতায় গিয়েও দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের মতে, ফরাসি বিপ্লবের পরই রুশোর সামাজিক চুক্তির ধারণা সন্ত্রাসের শাসনে পরিণত হয়। তা শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়নীয় স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। সোভিয়েত আমলেও বলশেভিক বিপ্লবের উত্তরসূরিরা জনমত দমন করেছিল, বাক্‌স্বাধীনতাকে হরণ করেছিল। এসবের মূলে ছিল জাতীয় নিরাপত্তার জিকির।

গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের শুরু থেকেই ফ্যাসিস্ট শাসন সময়ে সময়ে রূপ বদল করে ফিরে এসেছে। ফ্যাসিবাদের বর্তমান রূপ হচ্ছে উন্নয়ন মডেল। এই মডেল নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের কথা বলে অধিকতর উন্নয়নের ধোঁকা দেয়। ইতিহাসের অনেক ফ্যাসিস্ট শাসকই নির্বাচিত ছিলেন। কিন্তু পরে তাঁরা নির্বাচনকে স্রেফ এক জালিয়াতির অনুষ্ঠানে পরিণত করেন। হয় এঁদের অধীনে নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই থাকে না বা ব্যাপক কারচুপি হয়। কারচুপি, দুর্নীতি ও অপশাসনকে ধামাচাপা দেওয়া জন্য বাক্‌স্বাধীনতা স্তব্ধ করতে নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন করেন। তাঁরা যত্রতত্র ‘উন্নয়নবিরোধী’ শক্র দেখতে পান। যেকোনো কিছুকেই মনে করেন ষড়যন্ত্র। কখনো কখনো ধর্মকেও ব্যবহার করেন। ধনিক শ্রেণিকে অবারিত লুটপাটের সুবিধা করে দেওয়া হয়। অবাধ দুর্নীতির কারণে ঘন ঘন ব্যাংক, বিমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান মূলধন হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যায়। ঋণখেলাপিরা মুক্তি পায়। নাগরিক সেবার চেয়ে ব্যবসায়ী স্বার্থে বড় বড় অবকাঠামো বানানোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

চীন, তুরস্ক, মিয়ানমার, ভারত ও আমেরিকা উন্নয়নকে আঁকড়ে ধরা ফ্যাসিজমের বড় উদাহরণ। আমেরিকায় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকান মডেল কাজ করছে না। আমেরিকা নাগরিক অধিকার অনেক বেশি খর্ব হয়েছে। যেমন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আইন। আমেরিকার যে মডেল মানবাধিকারকে ঘিরে বিকশিত হয়েছিল, তা পুনরায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকেই ফিরে গিয়েছে। চীনও উন্নয়নের কথা বলে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করছে। ভারত স্বাধীনতার পর মোটামুটি গণতন্ত্রের পথে থাকলেও বর্তমানে ক্রমেই ফ্যাসিস্ট চরিত্র পরিগ্রহ করছে। মিয়ানমারেও চরম ফ্যাসিস্ট শাসন চলছে। সেখানে কোনো নাগরিক অধিকার নেই। রোহিঙ্গাদের ওপর দমন, নিপীড়ন ও দেশছাড়া করার পর আর নতুন করে কিছু বলার নেই। ইরানেও চলছে সীমিত গণতন্ত্র। তুরস্কে বিরোধী দলের কোনো স্থান নেই। কোথাও উন্নয়ন, কোথাও ধর্মের দোহাই দিয়ে চলছে ফ্যাসিস্ট শাসন।

বিভিন্ন দোহাই দিয়ে ফ্যাসিজম বারবার ফিরে আসে। ইতালিয়ান দার্শনিক উমবার্তো ইকোর মতে, ফ্যাসিজম নতুন নতুন ছদ্মবেশ নিয়ে ফিরে আসে। এখন যেমন উন্নয়ন মডেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে থাকছে জাতীয়তাবাদ, ইতিহাসের গৌরব এবং সংস্কৃতি ও প্রগতির বড়াই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে ফ্যাসিবাদকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

তবে কি আধুনিক রাষ্ট্র কাগুজে দলিল হিসেবেই রইল? পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব অনেকাংশেই কম। কিন্তু আমেরিকান বা চায়নিজ পুঁজিবাদ কোনো সমাধান হাজির করতে পারেনি; বরং যেকোনো মূল্যে পুঁজির সঞ্চালন ঠিক রাখার দিকে নজর দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে যখনই কর্তৃত্ববাদী শাসনে কোনো দেশ চলে যায়, তখনই পুঁজির জোগান কমে যায়। তাই সমাজ নিজ উদ্যোগেই কর্তৃত্ববাদীকে ছুড়ে ফেলবে। সমাজ যে আইন, সংবিধান, রাষ্ট্র, প্রথা, রীতি তৈরি করে, তা ফ্যাসিস্ট শাসনে তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়। তাই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহও শুরু হয়। সব পাল্টে ফেলে। বদলে দেয়। এ কারণেই ইউরোপে ফ্যাসিস্ট শাসকেরা টিকে থাকতে পারেনি।

শিল্পবিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো কোনো সমাধান দিতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপে মার্ক্সবাদের সঠিক প্রয়োগ হয়নি। চীনের মাওবাদ ফ্যাসিস্টদের পাকাপোক্ত করেছে। আমেরিকানরাও ব্যর্থ। তবে বিশ্বব্যবস্থার নতুন কাঠামো কী হবে? আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। চীনা পুঁজিবাদ ও আমেরিকান পুঁজিবাদের লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা এখনো হয়নি। এদের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা হলেই বিশ্বব্যবস্থায় নতুন এক কাঠামো দেখতে পাব।

ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় তাঁর ‘কাম সেপ্টেম্বর’ শীর্ষক বক্তৃতায় বলেছিলেন, কান পাতলেই তিনি সেই অনাগত বিশ্বের নিশ্বাস শুনতে পান। নিশ্চয়ই গুম, খুন, দমন, নিপীড়ন, যুদ্ধ, হামলা, উচ্ছেদ, দখলের অবসান ঘটবে। ফ্যাসিজম যতভাবেই ফিরে আসুক, তা টিকে থাকতে পারে না। খুব গভীরভাবে কান পাতলে সেই সব মুক্তিকামী মানুষেরও জেগে ওঠার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। খালি ঠাহর করে একটু কান পাততে হবে। অবশ্য ফ্যাসিস্ট শাসক ও তাঁর সমর্থকেরা তা কখনোই শুনতে পান না। ক্ষমতার মোহে তাঁরা বধির।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।