অতি ধনীদের ব্যাংক লুটের সংস্কৃতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’–এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭—এ পাঁচ বছরে অতি ধনী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বের সব বড় অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলে ১ নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অতি ধনী লোকের সংখ্যা ২৫৫। এ দেশে ধনী লোকেরা যেভাবে নিজেদের আয় ও ধনসম্পদ লুকানোতে পারদর্শী, তাতে হয়তো অতি ধনীর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সালের পুঁজিবাদী বিকাশে ‘রবার ব্যারন’দের (Robber Baron) ভূমিকার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ৪৭ বছরের রাঘববোয়াল পুঁজি লুটেরাদের অবিশ্বাস্য ধনসম্পদ আহরণের পদ্ধতির বিস্ময়কর মিল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘রবার ব্যারন’ বলা হতো শুধু সেই সব ব্যবসায়ী–শিল্পপতিকে, যাঁরা ‘সফল’ হয়েছেন অনৈতিক পন্থায়। সৎ পন্থায় সফলতা অর্জনকারী ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের এই অভিধা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অধিকাংশ ধনকুবেরের ক্ষেত্রে অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং ক্ষমতাসীন শাসকমহলের পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ‘রবার ব্যারন’ ছিলেন জন ডি রকফেলার, কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট, অ্যান্ড্রু কার্নেগি, অ্যান্ড্রু মেলন, জন জ্যাকব অ্যাস্টর, জে কুক, জেমস বুখানান ডিউক, জে পি মর্গান, হেনরি মরিসন ফ্ল্যাগলার, জন সি অসগুড, চার্লস এম শোয়াব, চার্লস ক্রকার, হেনরি ক্লে ফ্রিক, ড্যানিয়েল ড্রু, জে গোল্ড, জেমস ফিস্ক, জন ওয়ার্ন গেইটস, ই এইচ হ্যারিম্যান, হেনরি ব্রেডলি প্ল্যান্ট, জোসেফ সেলিগম্যান, জন ডি স্প্রেকেলস, চার্লস এইরকেস ও লেলান্ড স্ট্যানফোর্ড। তাঁদের ধনসম্পদের আহরণের পদ্ধতি ছিল দুর্বৃত্তায়িত। তাঁরা ঠিকমতো সরকারের কর দিতেন না, অথচ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। ১৮৭০-১৯১৪ পর্যায়ে তাঁরা মার্কিন রাজনীতি প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁদের ছলচাতুরী ও ধূর্ত কূটকৌশলের কারণে মার্কিন শেয়ারবাজার ওয়ালস্ট্রিট এবং অনেকগুলো মার্কিন ব্যাংক বেশ কয়েকবার পুঁজি লুণ্ঠন ও গুরুতর সংকটের শিকার হয়েছিল। আজকের দিনের বিশ্ববিখ্যাত বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাঁদের কয়েকজন। এটাও জানা প্রয়োজন, ধনকুবের রবার ব্যারনদের অনেকেই শেষ জীবনে ধনসম্পদ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে দান করে গেছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে গেছেন এবং ট্রাস্ট স্থাপন করে ধনসম্পদ দাতব্য কর্মে ব্যয়ের ব্যবস্থা করেছেন।

 মুক্তবাজার অর্থনীতি নামধারী ‘বাজার মৌলবাদী পুঁজিবাদের’ পথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যে আয় ও সম্পদ ক্রমেই একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হয়, তারই অকাট্য প্রমাণ হলো বাংলাদেশেও ধনকুবেরদের সংখ্যার ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির খবর। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের দোর্দণ্ড প্রতাপের কারণেই ৪৩ বছর ধরে বাংলাদেশে এই ২৫৫ জন (বা আরও কয়েক শ) রবার ব্যারনের উত্থান ঘটেছে। এই উত্থানের প্রধান সিঁড়ির ভূমিকা পালন করেছে নিচের প্রক্রিয়াগুলো:

১. ব্যাংকঋণের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ; ২. বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর পুঁজি লুণ্ঠন; ৩. সরকারের গৃহীত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিকভাবে অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে পুঁজি লুণ্ঠন; ৪. অস্বাভাবিকভাবে প্রকল্প বিলম্বিতকরণের মাধ্যমে পুঁজি লুণ্ঠন; ৫. ব্যাংকের মালিকানার লাইসেন্স বাগানো এবং ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাংকঋণ লুণ্ঠন; ৬. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও প্রাইভেট টেলিভিশন স্থাপনের ব্যবসা; ৭. শেয়ারবাজারে কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে পুঁজি লুণ্ঠন; ৮. একচেটিয়ামূলক বিক্রেতার বাজারে (collusive oligopoly) যোগসাজশ ও দাম নিয়ন্ত্রণ; ৯. রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও অত্যধিক দাম বৃদ্ধি; ১০. ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকঋণ খেলাপ ও বিদেশে পুঁজি পাচার; ১১. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বখরা-ভাগাভাগির মাধ্যমে ব্যাংকঋণ লুণ্ঠন; ১২. একের পর এক অযৌক্তিক মেগা প্রকল্প থেকে রাজনৈতিক মার্জিন আহরণ, এবং ১৩. রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।

 আমার মতে, বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ব্যাংকঋণ লুণ্ঠন। ১৯৭২ সাল থেকেই ‘ব্রিফকেস ব্যবসায়ীদের’ আদলে ব্যাংকঋণ লুটেরাদের উদ্ভব হয়েছে। আর ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ব্যাংকঋণ বণ্টনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহারের সংস্কৃতি চালু করেছিলেন। স্বৈরাচারী এরশাদও সেটাকে তাঁর রাজনীতির প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন। তখন থেকেই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপের’ মাধ্যমে ব্যাংকঋণ লুণ্ঠনের অপসংস্কৃতি গেড়ে বসতে শুরু করে। ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের বিএনপি সরকারের সময় খেলাপি ব্যাংকঋণের সমস্যা সংকটে পরিণত হয়। আমি ১৯৯৮-২০০১ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক হিসেবে তিন বছরের ডেপুটেশনে দায়িত্ব পালনের সময় এ বিষয়ে আমার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম বিশদ গবেষণা পরিচালিত হয়। ১৯৯৭ সালে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া সংসদে ২ হাজার ১১৭ জন কোটিপতি ঋণখেলাপির যে তালিকা প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্য থেকে ১২৫টি দৈব নমুনা চয়নের মাধ্যমে আমরা ওই গবেষণাটি চালিয়েছিলাম। তারপর ১৯৯৯ সালে যখন প্রাথমিক ফলাফল একটি জাতীয় সেমিনারে উপস্থাপন করেছিলাম, তখন তা দেশে-বিদেশে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেমিনারের পরদিন (২০ মে ১৯৯৯) দেশের সংবাদপত্রগুলোতে ওই ফলাফল ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯ মে ১৯৯৯ তারিখের বিবিসি সান্ধ্য খবরে যখন ৭৭ শতাংশ ঋণখেলাপি কর্তৃক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ পাওয়ার খবরটা প্রকাশ পায়, তখন তা নিয়ে সংসদে জোরালো বিতর্কের অবতারণা করেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী। বেশ কিছুদিন গবেষণা বন্ধ রাখার পর গবেষণাপদ্ধতি পরিবর্তন করে বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে আমরা গবেষণাটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম, যা বই হিসেবে প্রকাশ পায় ২০১০ সালে।

এ দেশে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা মোটা অঙ্কের ঋণ বাগিয়ে তা আর পরিশোধ না করার ‘কালচার’ সৃষ্টি করেছেন, এর প্রামাণ্য দলিল হিসেবে আমার ও মহিউদ্দিন সিদ্দিকীর রচিত আ প্রোফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ দেশে-বিদেশে বহুল আলোচিত একটি বই। বইটিতে বাংলাদেশের ১২৫টি শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইল উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে দেশের ৩১ জন ‘স্টার ঋণখেলাপির’ কেস স্টাডি বর্ণিত হয়েছে। সেখানে দেশের বাঘা বাঘা ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতিদের বিশাল বিশাল ব্যাংকঋণ হজম করে ফেলার চাঞ্চল্যকর কাহিনি বিবৃত হয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতার এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে এসব কেস স্টাডিতে। এই কাহিনিগুলোকে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমান ‘হেয়ার রেইজিং স্টোরিজ’ বলে অভিহিত করেছেন বইটির মুখবন্ধে।

ওই গবেষণার সূত্রে দুই দশক ধরে আমি বাংলাদেশের কয়েক শ ‘রবার ব্যারন’ কর্তৃক ব্যাংকঋণ লুণ্ঠন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। তাই আমি নিঃসন্দেহ যে এ দেশের রবার ব্যারনদের সিংহভাগই প্রধানত ব্যাংকঋণ লুণ্ঠনের মাধ্যমেই ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন এবং এই ব্যাংকঋণের সিংহভাগই তাঁরা বিদেশে পাচার করে চলেছেন। গত কয়েক বছরে উদ্‌ঘাটিত হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, নুরজাহান গ্রুপ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি কিংবা শাহাবুদ্দিন আলম কেলেঙ্কারি প্রকৃতপক্ষে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ লুণ্ঠনের কাহিনির ‘টিপ অব আইসবার্গ’ মাত্র।

১৯৭৫ সালের পর ৪৩ বছরে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই রবার ব্যারনদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের রাজনীতি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আঁকড়ে ধরে রয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২৭ বছর ধরে নির্বাচিত সরকারগুলো পালাক্রমে ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও রবার ব্যারন সৃষ্টিতে কোনো ভাটার টান দেখা যায়নি, শুধু রবার ব্যারনদের দলীয় রং বদল ঘটে চলেছে।

ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়