নতুন রাজনীতির যুগে বাংলাদেশ!

খালেদা জিয়া ও  ড. কামাল হোসেন
খালেদা জিয়া ও ড. কামাল হোসেন

বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই এক নতুন যুগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। শত প্রতিকূলতা নিয়েও দেশটির প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।

অনেকে ভাবতেই পারেননি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি, রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড লাভের মতো ঘটনা এবং সেই সঙ্গে অল্প সময়ের ব্যবধানে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যথাক্রমে ৭ ও ১০ বছরের কারাদণ্ড, প্রার্থী হতেই অযোগ্য হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং দলীয় গঠনতন্ত্রের আওতায় মাতা-পুত্র উভয়ের নেতৃত্ব অকার্যকর হওয়ার মতো রূঢ় বাস্তবতায় তারা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

বিএনপি ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনই কেবল নয়, তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কার্যকরভাবে বয়কট শুরু করেছিল ২০১১ সালের জুন মাসে, যখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলোপ করা হয়েছিল। সে হিসেবে নিরঙ্কুশ দলীয় সরকারের অধীনে প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচন করাতে রাজি করানো বিরাট ঘটনা। এ জন্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের ধন্যবাদ প্রাপ্য।

এখন এর প্রতি ন্যূনতম রাজনৈতিক মর্যাদা দেখানো ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো কিংবা এর আগে ৭ দফা দাবির পরে গণভবনে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে দৃশ্যমান কোনো সুবিধা বা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার মতো তেমন কিছুই না দিতে পারা ভালো কথা নয়। তাই ক্ষমতাসীন দলের এখন উচিত হবে বিরোধী দলের প্রতি সংবিধানসম্মত কোনো শুভেচ্ছা-ছাড় জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা। এটা ঠিক, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি সংসদে থাকা অবস্থায় তাদের কথিতমতে পাঁচটি মন্ত্রণালয় দেওয়ার একটি অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাতাসে ভাসছিল। কে কবে কোন কোন মন্ত্রণালয় দেওয়ার কথা বলেছিল, তার কোনো দালিলিক তথ্য আমাদের জানা নেই। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্যের হলো, এবার ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের দোহাই দিয়ে চার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীকে পদত্যাগ করানো হয়েছে। প্রথম আলোতেই প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, মন্ত্রীরা বলেছেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় বলেছে, নির্বাচনকালে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী রাখা যাবে না।’ অথচ এটা সঠিক নয়। ওই রায়ে এমন কিছুই বলা নেই। উপরন্তু সংবিধান অনুযায়ী সরকার চাইলে বিএনপি মনোনীত এমন একাধিক ব্যক্তিকে মন্ত্রী করা সম্ভব। এখন এমন ভাব করা হচ্ছে, সংবিধান বাধা না দিলে কী হবে, বিএনপি সংসদে নেই বলেই আগের প্রস্তাব তামাদি হয়ে গেছে!

সত্যিই তো, বাস্তবে বিএনপিকে কৌশলগতভাবে ‌‌‘হারিয়ে দেওয়া’ সম্ভব হয়েছে, সুতরাং এখন তাকে আরও বেকায়দায় ফেলতে নাকি আইনের আওতায় তাকে যথা অধিকার দিতে রাষ্ট্রযন্ত্র যথা আচরণে কতটা কী কাজ করে, সেটা দেশে-বিদেশে দেখার বিষয় হয়ে থাকবে।

ইউপি নির্বাচনে আমরা দেড় শ মানুষ খুন হতে দেখেছি। আশা করব আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনী আইন ও তার নিজের গঠনতন্ত্র মেনে প্রার্থী বাছাই এবং কম সহিংস উপায়ে তার ঘর সামলাতে সক্ষম হবে। মনোনয়ন ফরম বিতরণ নিয়ে সহিংসতায় যে দুটি প্রাণ আমরা ঢাকায় হারাতে দেখেছি, তা আমাদের গভীরভাবে বিচলিত করেছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে রাজনীতিতে এই যে নতুন অগ্রগতি, তাতে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করি। উভয় পক্ষের সংযম দরকার, বিশেষ করে বিরোধী দল ও মত দলন বন্ধ হোক।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরকে বলা যেতে পারে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটানোর দিন। সেদিন একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিতর্কিত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর যে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে, তারই পরিণতিতে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। রাজনৈতিক ভুলের খেসারত বিএনপিকে নয়, সমগ্র জাতিকে দিতে হয়েছে।

২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর বিএনপি রাজপথে যে রাজনৈতিক বিরোধের ফয়সালা করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সফল হয়নি। বরং ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে তাকে আগুন ও বোমাবাজির অপবাদ নিতে হয়েছে।

সেই বিবেচনায় আজ রাজনীতি নতুন মোড় নিয়েছে। এখন নির্বাচনটি সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু হলে সেটি হবে ষোলো কোটি মানুষের বিজয়। এখন সকল মত ও পথের রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মেলবন্ধন হতে পারে। মনে রাখতে হবে, এই দেশ সবার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যতই মতভেদ থাকুক না কেন, সেটি নিষ্পত্তি করতে হবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়। সরকারের দমন-পীড়ন কিংবা বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাজপথে রাজনৈতিক মতবিরোধের কিনারা হবে না।

বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার একটি বড় রাজনৈতিক বৈধতা পেল, যা সংবিধান এত দিন তাদের দিতে পারেনি। এখন আমরা আশা করব, এই বৈধতাদানের বিষয়টি যে একতরফা বা চিরস্থায়ী নয়, ক্ষমতাসীন দল সেটি তাদের দায়িত্বশীলতা দিয়ে পরিষ্কার করবে। জনপ্রশাসনকে আইনের পথে হস্তক্ষেপ ছাড়াই চলতে দিতে হবে।

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সত্যিই নতুন কিছু পেতে পারি। আমাদের জনগণ সত্যি এর থেকে ভালো কিছু পাওয়ার হকদার।

অতীতে কখনোই একটি শক্তিশালী বিরোধী দল ক্ষমতাসীন মন্ত্রিসভার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমন ঘটনা ঘটেনি। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে সংগত কারণেই কোনো শক্তিশালী বিরোধী দলের অবস্থান ছিল না এবং সামরিক বা আধা সামরিক শাসন আমলে আওয়ামী লীগ যদিও ‘দলীয় সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, কিন্তু তারা যথেষ্ট প্রতিকূল অবস্থায় ছিল।

আমাদের এটা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে সারা দেশের ভোটাররা, বিশেষ করে জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল এবং তারা এখন সতর্কতার সঙ্গে আশা করতে শুরু করবে যে আসন্ন ভোট গ্রহণের পর্বটি উৎসবে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশ যদি সহিংসতামুক্ত পরিবেশে আসন্ন নির্বাচন করতে পারে, তাহলে সেটা শেখ হাসিনার অধীনে থাকা উন্নয়নের রথকে আরও বেগবান ও টেকসই করবে। তৈরি হবে নতুন এক ইতিহাস। এই অর্জন তাঁকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনের তফসিল পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। এটা ভালো কথা। তবে আশা করব যে আচরণবিধি পরিপূর্ণভাবে পালন করার মধ্য দিয়ে উত্তম পরিবেশ বজায় রাখাটা সরকারি দল বিশেষ বিবেচনায় রাখবে।

যে প্রচলিত নিয়মকানুন, বিশেষ করে যে নির্বাচনী আচরণবিধি রয়েছে, তা যদি নিরপেক্ষভাবে নির্দলীয়ভাবে এবং নির্ভুলভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, তাহলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হতে পারে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই ভালো হতো। বিধিবিধান মানলে সংসদ রাখলেও প্রতিপক্ষের বড় ক্ষতি হবে না। সংসদ ভেঙে আচরণবিধি না মানলে খুব লাভ হবে না। লঙ্ঘনের ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি থাকবে, তাদের কাজ হবে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকা।

সভা-সমিতি অনুষ্ঠানসংক্রান্ত যে বাধানিষেধের কথা বলা আছে, সেটা সরকারি দল ও মিত্ররা এখনই ভালোভাবে অনুসরণ করতে পারে। আচরণবিধি বলছে, ‘নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা তার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি প্রচারণার ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাবে। শোভাযাত্রা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সভার সময় ও স্থান সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিতভাবে জানালেই হবে।’ এখন পুলিশ একচোখা নীতি অনুসরণ করলে কে প্রতিকার দেবে? আইনত প্রতিকার করার কথা ইসির। কিন্তু ইসি যদি কারও অঙ্গুলি হেলনে চলে তখন কী হবে?

আচরণবিধি বলছে, সভার অনুমতির লিখিত আবেদনপ্রাপ্তির ক্রমানুসারে প্রদান করতে হবে। সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে এটা নিশ্চিত করার কথা ইসির। তারা পারবে কি? বিধি বলছে, প্রস্তাবিত সভার কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা আগে তার স্থান এবং সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে, যাতে ওই স্থানে চলাচল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তার মানে, পুলিশকে বশে রাখতে ইসিকে সজাগ থাকতে হবে। এর লঙ্ঘন ঘটালে এখন আর সরকার নয়, ইসিকে দায় নিতে হবে। সংবিধান এটাই নির্দেশ করছে।

সতর্কীকরণ: বিএনপি নিজে নয়, ঐক্যফ্রন্টের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং একটা ফাঁক তারা রেখেছে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।
[email protected]